অস্ত্রবাজির ভিডিও ভাইরাল, এখনও অধরা কক্সবাজারের রুস্তম
অস্ত্র জমা দেয়নি আ.লীগ নেতা মকসুদ সহ অনেকেই
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২২:৫২ | অনলাইন সংস্করণ
এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে কক্সবাজারে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রুস্তম আলী চৌধুরীর অস্ত্রবাজির ঘটনায় ভাইরাল হওয়া ভিডির অস্ত্রটি জমা দিয়েছে তার পরিবার। জমা দেয়া অস্ত্রটির প্রসঙ্গে তদন্ত নেমে আলোকিত বাংলাদেশ এর হাতে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এর সূত্র ধরে গতকাল বুধবার দুপুরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনুসন্ধান করে এই তথ্যের সত্যতা মিলেছে। অন্যদিকে জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, কক্সবাজারে ২০৫টি বৈধ অস্ত্র রয়েছে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত ১০৬টি জমা দিয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল গনি ওসমানী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তথ্যমতে, মহেশখালীর পৌর মেয়র, আওয়ামী লীগ নেতা মকসুদ মিয়া সহ আ.লীগ ও তার সহযোগি সংগঠনের অনেক নেতা এখনো অস্ত্র জমা দেয়নি। আওয়ামী লীগ নেতা মকসুদ মিয়ার নামে একটি শট গান ও একটি পিস্তল ইস্যু করা হয়েছিল ২০১৪-১৫ সালে।
স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রুস্তম আলী চৌধুরীর ইস্যুকৃত অস্ত্রের কাগজপত্র ঘেটে দেখা গেছে, চলতি বছরের ২০২৪ সালের ৭ মে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রুস্তম আলী চৌধুরীর নামে ‘ইতালিয়ান মডেল’ এর বৈধভাবে একটি ‘পিস্তল’ ইস্যু হয়। ওই পিস্তলের অধীনে ৫০ রাউন্ড গোলাবারুদ সংগ্রহ করার সুযোগ রয়েছে। তবে রুস্তমের অস্ত্র জমা দেয়ার তথ্যমতে দাবি করেছে, তাঁর (রুস্তম) নামে ইস্যুকৃত অস্ত্রের অধীনে ৪০ রাউন্ড গুলি সংগ্রহ করেছেন তিনি। তা আবার অস্ত্রের সাথে জমাও দিয়েছেন। তার এই দাবি নাকচ করে গতকাল বুধবার বিকালে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দাবি করেন, রুস্তম তাঁর ইস্যুকৃত অস্ত্রের অধীনে ৫০ রাউন্ড গোলাবারুদ সংগ্রহ করেছিল। তবে জমা দিতে ৪০ রাউন্ড দিয়েছে। ওই কর্মকর্তার মতে, নিশ্চয় রুস্তম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে ১০ রাউন্ড গুলি ব্যবহার করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রটি বলছে, কারো নামে বৈধভাবে অস্ত্র ইস্যু করা হয় সাথে গোলাবারুদও থাকে। যদি ওই গোলাবারুদ কোন কারণে ব্যবহার হলে সংশ্লিষ্ট থানায় বিস্তারিত উল্লেখ করে জিডি করতে হয়। এদিকে গতকাল কক্সবাজার সদর মডেল খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা তাঁর বৈধ অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে থানায় কোন জিডি করেনি।
থানার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রুস্তমের অস্ত্র ইস্যুকৃত তথ্য মতে, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি ১০ রাউন্ড গুলি চালিয়েছেন। তাঁর অস্ত্র ব্যবহারের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গতকাল তাঁর দপ্তরে এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল গনি ওসমানী ‘স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা রুস্তম আলী চৌধুরী অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, সোমবার তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ইতালিয়ান মডেলের ইস্যুকৃত পিস্তল ও ৪০ রাউন্ড গুলি জমা দেন। রুস্তমের নামে কতো রাউন্ড গুলি ইস্যু হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী তার অস্ত্রের অনুকূলে ৫০ রাউন্ড গুলি সংগ্রহ করার কথা। তবে তার পরিবার ৪০ রাউন্ড গুলি জমা দিয়েছে। তবে এই কর্মকর্তার কাছে রুস্তমের অস্ত্রের ইস্যুকৃত কাজের ছায়া কপি না থাকায় বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারেনি এই কর্মকর্তা।
সূত্রমতে, কক্সবাজারে ১৬ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্র- জনতার আন্দোলন দমাতে কক্সবাজার শহরে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেয়া হয়। ইতিমধ্যে আলোকিত বাংলাদেশ এর প্রতিবেদকের হাতে কয়েকটি ভিডিও এসেছে। এর মধ্যে যুবলীগ নেতা মারুফ হোসেন প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। অপর একটি ভিডিতে দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রুস্তম আলী চৌধুরী মিছিল থেকে অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়া দিচ্ছেন। ওই মিছিলের ভিডিওতে দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সামনে, পেছনে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া আরো কয়েকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, হেলমেট পরিহিত কালো টি-শার্ট পরিহিত যুবক ভারি অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেন। ইতিমধ্যে কক্সবাজার জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রুস্তম আলী চৌধুরী ও যুবলীগ নেতা মারুফ হোসেনের অস্ত্রবাজির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অস্ত্রবাজসহ আওয়ামী লীগ নেতারা আত্নগোপনে চলে যান। দীর্ঘ এক মাসের অধিক সময় পার হলেও একজন অস্ত্রবাজকে গ্রেফতার করতে না পারায় ছাত্র -জনতার মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অনেকেই পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে আওয়ামী লীগের একাধিক মিছিল মিটিং এ স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রুস্তম আলী চৌধুরী অধিকাংশ সময় প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি করে থাকেন। অনেকটা পুলিশের উপস্থিতিতে সে অস্ত্রবাজি করেন। তার অস্ত্রবাজি প্রত্যক্ষ করে ওই সময়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা তাঁর প্রশংসা করেন। জেলা প্রশাসনের তথ্য সূত্র মতে, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রুস্তমের অস্ত্রটি বৈধ হলেও যুবলীগ নেতা মারুফ হোসেনের অস্ত্রটি বৈধ নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এক ঘোষণায় ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া সকল ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করে। একই সঙ্গে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সকল বৈধ লাইসেন্স গ্রহীতার স্থায়ী ঠিকানার থানায় অথবা বর্তমান বসবাসের ঠিকানার নিকটস্থ থানায় লাইসেন্স গ্রহীতা নিজে বা মনোনীত প্রতিনিধির মাধ্যমে অস্ত্র জমা দিতে বলা হয়।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাহফুজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে অস্ত্রবাজির ঘটনায় গণমাধ্যম ও সোস্যাল মিডিয়ার সূত্র ধরে অনেককে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।
দুই প্রজ্ঞাপন
গত ২৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক অধিশাখা-৪ থেকে প্রকাশিত জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. জহিরুল হক স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বিগত ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি হতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত যে সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বেসামরিক জনগণকে প্রদান করা হয়েছে তা স্থগিত করা হলো এবং তাদেরকে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। The Arms Act, 1878 (Act XI of 1878) এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রধান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা-২০১৬ অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ওই প্রজ্ঞাপনে স্মারক নম্বর ছিল ৪৪.০০.০০০.০৭৭.২১.০২৫.২০২১-৩৩০, তারিখ: ২৫ আগস্ট ২০২৪।
একইদিন একই স্মারক নম্বর প্রতিস্থাপন করে উপ-সচিব মো. আরিফ উজ জামান স্বাক্ষরিত আরেকটি প্রজ্ঞাপন পাওয়া যায়। ওই প্রজ্ঞাপনের শুরুতে লেখা হয় ‘একই স্মারক ও তারিখ প্রতিস্থাপিত।’ তাতে বলা হয়, ‘বিগত ২০০৯ সালের ০৬ জানুয়ারি হতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য প্রদত্ত সকল আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স (কর্মরত সামরিক-অসামরিক কর্মকর্তা ব্যতীত) স্থগিত করা হলো। স্থগিতকৃত লাইসেন্সভুক্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদসমূহ আগামী ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখের মধ্যে লাইসেন্স গ্রহীতার স্থায়ী ঠিকানার থানায় অথবা বর্তমান বসবাসের ঠিকানার নিকটস্থ থানায় লাইসেন্স গ্রহীতা নিজে/মনোনীত প্রতিনিধির মাধ্যমে জমা প্রদান করবেন। উক্ত তারিখের মধ্যে কোনো অস্ত্র/গোলাবারুদ থানায় জমা না দেওয়া হলে অবৈধ অস্ত্র হিসেবে গণ্য করে অস্ত্র আইনে মামলা হবে। ইতোমধ্যে যাদের আগ্নেয়াস্ত্র থানা, জেলা ট্রেজারি ও আর্মস ডিলারদের নিকট জমা রাখা আছে; তাদের ক্ষেত্রে অস্ত্র জমাদানের বিষয়টি প্রযোজ্য হবে না। The Arms Act, 1878 (Act XI of 1878) এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬ অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।