কক্সবাজারের উখিয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে যার হাতে শাসন হতো, এখন সেই শাসকের বিরুদ্ধে শাসন শুরু হয়েছে। যার কথায় মামলা নেয়া হতো, আবার মামলা তুলেও নেয়া হতো, যার দাপটে এলাকার মানুষের ঘুম হারাম ছিল এখন সেই ক্ষমতাধর নিজেই মামলার আসামি।
ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে, গত ১৬ বছরে অসংখ্য অপরাধ করেও পার পেয়ে গেছেন তিনি। বিচার হয়নি বহুল আলোচিত গরিবের জন্য বরাদ্দকৃত( ভিজিডি) সরকারী চাল চুরি বা আত্মসাত মামলার। উক্ত মামলা থেকে রেহাই পেতে বিশাল অংকের অর্থ ব্যবহার করে নানা কৌশলে আপাতত চালিয়েছে দায়িত্ব। কিন্তু ক্ষমতা বলে কথা। পতিত সরকারের এমপি শাহিন আক্তার, সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমানের যোগসাজসে ইউপি পরিষদ থেকে চাল চুরি বিচার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘ সময় বাধাগ্রস্ত করে রেখেছেন উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী।
এ কারণে সাম্প্রতিক গণআন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের পর ইতিমধ্যে এই মামলা গুলো পুনরায় তদন্ত বা দ্রুত নিষ্পত্তি দাবি উঠছে সুশীল সমাজ সহ বিভিন্ন মহল থেকে। এতবড় কেলেংকারি ধামাচাপা দেয়ার বা বছরের পর রায় বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা প্রতিহতের দাবিও জোরালো হচ্ছে ক্রমশ। রাতারাতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবি ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে প্রচার হচ্ছে।
ইমরান খান নামে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের টাইমলাইনে সরকারের সম্পদ উদ্ধার করার জন্য উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেছেন, "উখিয়ার জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী ও তার ভাই হুমায়ুন কবির চৌধুরী এবং তাদের সহচর তহিদ, মফিজরা মিলে বনবিভাগের শত-শত একর জমি দখল নিয়েছে।
রাজাপালং ইউনিয়নের উপর্যুপরি তিনবারের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী সর্বশেষ অনুষ্ঠিত গত ২৯ মে তার অবৈধ ব্যবসার সিন্ডিকেটের অন্যতম কারিগর মফিজ মিস্ত্রির নেতৃত্বে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদটি দখল করেন নেন। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদটি হাতিয়ে নেয়ার পর পরই সবচেয়ে বেশি দাপট দেখাতে শুরু করেন তিনি।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত অভিযোগে জানা যায়,সর্বশেষ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদটি পাবার পর থেকে তিনি এমনই বেপরোয়া হয়ে উঠেন যে, সর্বত্র যেন 'খাই খাই' করে চলাফেরা করতেন। সকাল থেকে রাত অবধি কাকে মারে আর কাকে ধরে আর কাকে হুমকি দেয় আর কার উপর মামলা দেয় এই নিয়ে পুরো উখিয়া উপজেলা এলাকা জুড়েই ছিল এক অজানা আতংক। তার চলাফেরা ছিলো যুবরাজ বা নতুন জামাইয়ের মতো।
সরেজমিনে তার রোষানলের শিকার অনেক ভুক্তভোগীরা জানান, জমি দখল, টেন্ডারবাজি ও তার প্রতিপক্ষের লোকদের দমন করা হয়ে উঠে ছিলো তার নেশা বা পেশা। কেননা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীরের রয়েছে নূর মোহাম্মদ বলী, শামসু বলী, মফিজ মিস্ত্রির নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক লোকের সশস্ত্র একটি বাহিনী। যার কাজ হলো তার মতের সাথে ভিন্নমত পোষণ করা লোকদের দমন করা। এছাড়াও কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও ডাকাত শাহজাহানের নেতৃত্বে গড়ে তুলেছিলেন ২০ জনেরই একটি কিলার গ্রুপ । তাছাড়া ১০ জনের তার সশস্ত্র দেহরক্ষীর ভূমিকা পালন করত একটি টিম। এসব টীমে সদস্য ছিলো রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর গোষ্ঠীর অসংখ্য সদস্যও। যারা অপহরণ কর্মকান্ড ও গোলাগুলিতে জড়িত থাকে। শুধু তাই উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের মধুরছড়া এলাকায় বনবিভাগের জায়গা দখল করে রাতারাতি একটি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনকে বসবাসের আস্তানা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করে দিয়ে ছিলেন উখিয়ার মূর্তিমান আংতক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী। এই কাজের মনিটরিং এবং টাকা পয়সা দেনদরবারের সমন্বয়ক ছিলেন চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীরের ‘রাইট হ্যান্ড’ খ্যাত মফিজ মিন্ত্রি থেকে রাতারাতি খ্যাতি লাভ করা মফিজ কন্ট্রাক্টর। এসব জঙ্গির প্রতিষ্ঠানের টাকা লেনদেন হয়ো ছিলো মফিজ মিস্ত্রি ও মফিজের বোনের একাউন্টে এবং ক্যাশে। এসব অবৈধ ও রাষ্ট্রদ্রোহী টাকায় চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর নির্মাণ করেছে অর্ধশতক কোটি টাকা ব্যয়ে একটি রাজপ্রসাদ বাড়ী। যে বাড়ী সম্রাট শাহজাহান কতৃক নির্মিত তাজমহলকেও হার মানাবে।
কোন ব্যক্তি যদি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর অন্যায়ের বিষয়ে আপত্তি জানাত, তখন ১২ জনের ব্লগারদের দিয়ে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফেসবুকে নানা অশালীন এবং চরিত্র হননের মত একের পর এক শত শত পোষ্ট দিয়ে ওই ব্যক্তির চৌদ্ধ গোষ্ঠিকে কুপোকাত করে দিত। চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার ব্লগার বাহিনী। এই ব্লগার গ্রুপের নেতৃত্ব দিতেন অভিনব কায়দায় রোগী সেজে এম্বুলেন্সের মাধ্যমে বার্মিজ চোরাইপণ্য পাচার করতে গিয়ে ছাত্রজীবনেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক ও নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ( প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ) গণধোলাইযের শিকার হওয়া স্থানীয় এক সাংবাদিক। এসব বাহিনীর প্রতিজন সদস্যদের নামে রাজাপালং ও উখিয়া উপজেলা পরিষদের কাবিখা ও টেষ্ট রিলিফের প্রকল্প দিয়ে হরিলুটের সুযোগ করে দিতেন তিনি।
জাহাঙ্গীরের দৃষ্টিতে সংবাদকর্মীরাই ছিলেন তার বড় প্রতিপক্ষ। যেসব সংবাদকর্মী আপষহীনতার পথে হেঁটেছেন তাদের বিরুদ্ধে তিনি মরিয়া হয়ে লড়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা যায় সর্বশেষ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উখিয়ায় সংঘটিত সংঘর্ষ, ছাত্র আন্দোলন দমনে মাস্টার মাইন্ড ছিলেন তিনি। এছাড়াও উখিয়া উপজেলা বিএনপি অফিস ভাংচুরসহ অগ্নিসংযোগের ঘটনায় যে মামলা হয়েছে তাতে এমন দাপুটে মানুষ সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীরকে আসামি করা হয়েছে।
জালিয়া পালং ইউনিয়ন প্যাইনাশিয়ার এলাকার বিএনপি নেতা জাগির হোসেন হত্যা মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অথচ তার আগেই সাবেক এই প্রতাবশালী চেয়ারম্যান তার অনুসারী ও নেতাকর্মীদের রেখে গোপনে লেজগুটিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। গত ১৫ বছর পর হলেও তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ তার অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। এতে তার বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসছে অজানা কুকীর্তি।
জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর কু-দৃষ্টিতে পড়ে গণমাধ্যমকর্মীসহ অনেকে বিভিন্ন ভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাদেরই একজন উখিয়া অনলাইন প্রেসক্লাবের সদস্য মোহাম্মদ ইমরানখান। তিনি জানিয়েছেন, একদিন বিএনপি অফিসের সামনে সংবাদ সংগ্রহের জন্য গেলে জাহাঙ্গীরের লালিত সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ইব্রাহীম, কাজল আইচ ও নিলয় গংরা আমার উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে মোবাইলটি ছিনিয়ে নেয়। যাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল। যে মোবাইল এখন ফেরৎ পায়নি তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অভিযোগ করার পরও।
মূলত: একজন চেয়ারম্যান হয়ে সুশিল সমাজের প্রতিনিধিদের নাজেহাল করেই মূলত তিনি মজা পেতেন-এমনটাই বলাবলি রয়েছে স্থানীয়ভাবে। অসহায় মানুষ তার অপরাধের প্রতিবাদ করতে না পেরে, শুধু মানুষই বলছে-এদিন দিন নয়, দিন আরো আছে। চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীরের অন্যায় আবদার না মানায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তারা প্রায়শ নাজেহালের শিকার হতেন। সরকারী কর্মকর্তা বা জনসাধারণ তাকে সালাম দিলেও তিনি সালামের উত্তর দিতেন না। কেউ হ্যান্ডশ্যাক করতে হাত এগিয়ে দিলে চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর তা না দেখার ভান করতো অথবা তার হাত উল্টো ছুঁড়ে মারার মত ন্যক্কারজনক ঘটনারও সৃষ্টি করতো। এমনকি কোন সরকারি কর্মকর্তা তার কথায় সায় না দিলে তাকে হয় বিএনপি - ছাত্রদল নতুবা জামায়াত- শিবিরের ক্যাডারের অপবাদ নিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করতে হয়েছে।
এরকমই উপজেলা থেকে একে একে চারজন ইউএনও কে এভাবে নিগৃহীত হয়ে বদলি হতে হয়েছে। এভাবে উখিয়ায় একছত্র রাজত্ব কায়েম করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে বিষিয়ে তুলেছিলেন অহমিকায় ভরা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর। অবশেষে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী সরকার পতনের সাথে সাথে এই অত্যাচারি জাহাঙ্গীর রাজত্বের পতন হওয়ায় ভুক্তভোগীসহ সাধারণ ছাত্র জনতা বেজায় খুশি। বিএনপি, জামায়াত ইসলামীসহ সুশীল সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিরা দাম্ভিক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী দাপুটে শাসনের অপকর্মের যাবতীয় তদন্ত সাপেক্ষে আইনের কাঠগড়ায় তোলার জন্য উখিয়ার ভুক্তভোগী গনমানুষের পক্ষ থেকে বর্তমান অন্তবর্তী কালীন সরকারের কাছে জোর দাবী জানিয়েছেন।
দেশের আলোচিত ইয়াবা ডন ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি, সাবেক সংসদ সদস্য আলমগীর মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ ফরিদ ( আলমগীর ফরিদ) তার ভগ্নীপতি। সাবেক সংসদ সদস্য শাহিন আক্তার তার আপন বড় বোন। সাবেক জেলা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবির চৌধুরী তার আপন বড় ভাই। সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম চৌধুরী তার পিতা। সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী তার আপন চাচা৷ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছেনুয়ারা বেগম তার আপন চাচী এসব ক্ষমতাধর লোকের তিনি আত্মীয় ও পারিবারিক সদস্য হওয়ার তিনি তার অপকর্মে শাস্তি পাবে কিনা স্থানীয় রাজনৈতিক সচেতন মহল এখনও সন্দিহান!