ভারী বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা সদর ও তালা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা এখন পানিতে নিমজ্জিত। বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় সাতক্ষীরা পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ড, সদরের ১০টি ইউনিয়ন ও তালা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের মোট ৭০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৩০ হাজারের বেশি পরিবার।
ছয় হাজার মাছের ঘের, দেড় হাজার পুকুর ও কাঁকড়ার হ্যাচারি ছাড়াও আমন ধান ও শাক-সবজির ক্ষেত ভেসে গেছে। পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বৃদ্ধ ও শিশুরা। বাড়ছে জনদুর্ভোগ। মৎস্য ও কৃষি খাতে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও জেলা মৎস্য অধিদপ্তর।
শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকালে সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ জুলফিকার আলী রিপন জানায়, গত সপ্তাহের শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) থেকে মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সকাল পর্যন্ত চার দিনে ৯৬ ঘণ্টায় ২৫৬ মিলিমিটার ও গত বুধবার ভোর থেকে বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
তালা উপজেলার আহসাননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিলন রহমান জানান, ভারী বৃষ্টির কারণে ১৫ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার বিনেরপোতা এলাকার শ্মশানঘাটের পাশের বেতনা নদীর পাউবোর রিংবাঁধ ভেঙে গিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে।
তালা উপজেলার নগরঘাটা গ্রামের জাকির হোসেন জানান, অতি বৃষ্টি ও বাঁধ ভেঙে তালা উপজেলার মাগুরা, খলিশখালি ইউনিয়নের আটুলিয়া থেকে মাগুরা বাজার সড়ক, মাদরা থেকে বালিয়াদহ, কলাগাছি থেকে মুড়াগাছা সড়ক ছাড়াও আহসাননগর হরিণখোলাসহ কয়েকটি গ্রামের বেশি কিছু সড়ক তলিয়ে গেছে। উপজেলার বিনেরপোতা, আহসাননগর, হরিণখোলা, গাছা, দক্ষিণ নগরঘাটা, হাজরাতলা, পালপাড়া, গাবতলা, দোলুয়া, নগরঘাটা, রথখোলা, কাপাসডাঙ্গা, মাদ্রা গুচ্ছগ্রাম, নিমতলাসহ কমপক্ষে ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
সাতক্ষীরা পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ হোসেন জানান, সাতক্ষীরা পৌরসভাসহ সদর উপজেলার মধ্যকার ছাকার মোড় থেকে শাল্যে বাজার, তালতলা থেকে গোপীনাথপুর ডেইয়ের বিল, মাঠপাড়া থেকে গদাই বিল, শহরের রথখোলা সড়ক, কামানগর, মধুমোল্লারডাঙিসহ সদরের বেশ কয়েকটি সড়ক পানির নিচে। ওই সব সড়ক দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারেছ না। এছাড়া, সদর উপজেলার পুরাতন সাতক্ষীরা এলাকার ঘুড্ডেরডাঙ্গী, রামচন্দ্রপুর, লবণগোলা, পাথরঘাটা, দামারপোতা, জিয়ালা, ধুলিহর, বালুইগাছা, ফিংড়ি, ফয়জুল্লাহপুর, দরবাস্তিয়া, কোমরপুর, তেঁতুলডাঙ্গী, মাছখোলা, খেজুরডাঙ্গা, গোপীনাথপুর, গোয়ালপোতা, তালতলা, শ্যালেসহ ৪০টি গ্রাম ও পৌর এলাকার অর্ধেক এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে ২০-২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ওই এলাকাসহ সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকার মাছ ও কাঁকড়ার ঘের তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে পুকুর, আমন ধান ও শাক-সবজির ক্ষেত।
তালা উপজেলার কলাগাছি ও মাদরা গ্রামের সুদেব মণ্ডল, হাজরা মণ্ডল ও সাবিত্রা মণ্ডল জানান, বর্তমানে তাদের এলাকায় জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। সুপেয় পানির অভাবে দূষিত পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। ঘাস, সবজি খেত, মরা গবাদিপশুসহ পচনশীল দ্রব্য পানিতে মিশে গেছে। পানি দূষিত হওয়ায় শিশু থেকে বৃদ্ধরা সর্দি, কাশি, জ্বর, আমাশয়, ডায়েরিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তারা আরও জানান, সড়ক পানির নিচে থাকায় হাসপাতালে নিতেও বেগ পেতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না।
তালা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের আমিনুর রহমান ও নির্মল মণ্ডল জানান, তার সতের বিঘার একটি মাছের ঘের রয়েছে। তাতে এক লাখ টাকার রুই, কাতলা ও মৃগেলসহ নানা জাতের মাছ ছাড়া হয়েছিলো। সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে ভেসে গেছে ওই ঘের।
এদিকে, সাতক্ষীরার জেলা নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আলী নুর খান বাবুল ও মানবাধিকার কর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত বলেন, বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীতে জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরানো, সাতক্ষীরা পৌরসভাকে পুরোপুরি ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রাণসায়ের খালের দুই মুখ উন্মুক্ত করে স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরানো, আন্তঃনদী সংযোগ বিশেষ করে ইছামতি, মরিচ্চাপ, খোলপেটুয়া, বেতনা, শালিখা ও কপোতাক্ষকে খননের আওতায় এনে পানিপ্রবাহ সচলকরণ, নদীগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলো পুনঃখনন করে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি, অকেজো হয়ে পড়ে থাকা স্লুইসগেটগুলো সংস্কারকরণ, পৌর এলাকার মধ্যে মৎস্য ঘের নিষিদ্ধকরণ, নদীগুলো খননের সঙ্গে সঙ্গে সংলগ্ন বেড়িবাঁধগুলোও টেকসই করে বেড়িবাঁধ বাঙন রোধ, বেড়িবাঁধে বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ, নদী ও খালের প্রবাহ বিঘ্নিত হয় এমন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ না করা, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের আগেই পানি নিষ্কাশনের পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিরুপণের মাধ্যমে জলবায়ু ফান্ডের অর্থ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম জানান, চলতি আমন মৌসুমে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে পাঁচ হাজার ৪৫২ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১৪৯ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার বাজার মূল্য ৯ কোটি টাকার বেশি।
কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এখন আমরা এই বৃষ্টির পানিতে সৃষ্টি হওয়া জলবদ্ধতা যদি নিরসন করতে পারি, তাহলে শাকসবজি ও আগাম খাদ্যশস্য আবাদের দিকে অগ্রসর হতে পারবো। আশা করছি, আবার সাতক্ষীরা জেলা ফসল উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে পারবে। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য বিভাগের উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান জানান, জেলায় গত কয়েক দিন অতিবৃষ্টির কারণে ও বেতনা নদীর বাঁধের একটা অংশ ভেঙে যাওয়ার কারণে তার আশপাশের ঘেরগুলো পানিতে মিশে গেছে। এখানে মোট ৫ হাজার ২৩০ হেক্টর এরিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পানিতে ভেসে গেছে অধিকাংশ মাছ। এতে মৎস্য চাষিদের ৭০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে সেটিও ৪ কোটি টাকার অধিক। এ ক্ষতির হাত থেকে চাষীদের রক্ষা করতে সহজ শর্তে যদি ঋণের ব্যবস্থা করা যেত, অথবা তাদের প্রণোদনার আওতায় আনা গেলে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।