স্বৈরাচার হাসিনা পতনের তিন মাস

কক্সবাজারে অধরা 'অস্ত্রবাজ', চুনোপুঁটি ধরে বাহবা নিচ্ছে পুলিশ

সহজেই মিলছে জামিন, আইনজীবী মহলে ক্ষোভ 

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭:০৫ | অনলাইন সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার পতনের তিনমাস পূর্ণ হলেও কক্সবাজারে প্রকাশ্যে 'অস্ত্রবাজির' ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যৌথ বাহিনী বিশেষ অভিযানে সিকি পরিমান অস্ত্রসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করলেও এখনো অধরা প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজির সাথে জড়িতরা। গ্রেফতার হয়নি মূল সারির কোন নেতাকর্মী। এনিয়ে ছাত্র -জনতার মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) হাতে উখিয়া-টেকনাফ আসনের আলোচিত সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি, তার ক্যাশিয়ার খ্যাত সালাউদ্দিন মেম্বার ও সহযোগী টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আলম গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু পুলিশের অভিযানে কোনো 'অস্ত্রবাজ' কিংবা মূল সারির নেতা এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়নি। 

গ্রেফতারকৃত আলোচিত সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির প্রধান সহযোগী সালাহউদ্দিন মেম্বারসহ অধিকাংশই নেতাকর্মী কক্সবাজার জেলা কারাগারে রাজার হালে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের নিস্ক্রিয়তায় স্বৈরাচারী সরকারের আমলের সুবিধাভোগী ছাত্র জনতার উপর গুলিবর্ষণকারী অনেকেই দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন। অনেকে আত্নগোপন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। অপরদিকে উপরের মহলকে খুশি করতে চুনোপুঁটি গ্রেফতার করলেও বরাবরের মতোই বাণিজ্য ও বির্তকের অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে গ্রেফতারকৃতদের আদালতে চালান দেয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে জামিন পাওয়ার নজির রয়েছে। অনেকটা বিচার ব্যবস্থায় এখনো রয়েছে স্বৈরাচারী ভূত। ইতিমধ্যে বিএনপি -জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা স্বৈরাচার হাসিনার দোসরদের জামিন নেয়ার বিষয় নিয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে একটি গোপন প্রতিবেদনও দিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরে।

পুলিশের পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বিএনপি-জামায়াতপন্থী কক্সবাজার আদালতে কর্মরত শীর্ষ ৮ জন আইনজীবীর নাম উল্লেখ রয়েছে। এবং দোসরদের পক্ষে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আরো ১৫-২০ জন আইনজীবী আসামিদের পক্ষে লড়ছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। 

পুলিশের এই প্রতিবেদনটি বিএনপির নীতিনির্ধারক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পৌঁছেছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। তারেক রহমান বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন বলে ওই সূত্রটি দাবি করেছেন। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চলমান আন্দোলনের সময় গত ১৬ জুলাই কক্সবাজারে বাসটার্মিনাল, লিংকরোড এলাকায় শাস্তিপূর্ণ কর্মসূচি শুরু হয়। পূর্ব নির্ধারিত গত ১৮ জুলাই বিক্ষোভ মিছিল শেষ করে ছাত্র-জনতা কক্সবাজার শহরের শহীদ মিনারে আসার চেষ্টা করে। তারা শহরের পেল্ট্রোল পাম্প অতিক্রম করার আগেই নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। পুলিশের উপস্থিতিতে শত শত রাউন্ড গুলি চালান অস্ত্রবাজরা। এমনকি ওই সময় অস্ত্রবাজ চক্র উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের ক্যামেরা, মুঠোফোনও অন করতে দেয়নি। ঘটনার সময় শহরের প্রধান সড়কের পৌরসভার লাইটগুলোও বন্ধ করে রাখেন অস্ত্রবাজরা। ওইদিন প্রায় রাতভর অন্ধকারে ছিল পুরো কক্সবাজার শহর। এ ঘটনার তিন মাস অতিবাহিত হলেও এখনো মূল অপরাধী ধরা পড়েনি। এর পরে ৪ আগস্ট কক্সবাজার শহরে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটে। 

আদালত ও জেলা পুলিশের সূত্র মতে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর মঙ্গলবার পর্যন্ত কক্সবাজারে ২৫টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্য একটি মামলার বাদি পুলিশ। অন্য মামলার বাদি বিএনপির নেতাকর্মী ও ছাত্রদের পক্ষের লোকজন। ওই ২৮টি মামলায় এজাহারনামীয়  ১৩১১ জনকে আসামি করা হয়েছে। এবং সন্দিগ্ধ আসামি ২৫০০ জন। ইতিমধ্যে পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়ে এজাহারনামীয়সহ অর্ধশতাধিক আসামিকে গ্রেফতার করেছেন। এর মধ্যে অধিকাংশ আসামী বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীদের লড়াইয়ে মুখে জামিন বেরিয়ে এসেছেন। 

অভিযোগ উঠেছে,  থানা থেকে আদালতের হাজতখানায় না ঢুকার আগেই জামিনমুক্ত হয়েছে। এই নিয়ে বিএনপির তৃনমুল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। 

কক্সবাজার জেলা বিএনপির সদস্য ও জ্যৈষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী দোসররা ১৫ বছর জুলুম-লুটপাট করেছে। কিন্তু এখন আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা তাদের জামিন করাচ্ছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। আত্মীয়তার দোহাইয়ে যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে ছাত্র-জনতা অসংখ্য আত্মবিসর্জনে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতার আদর্শ ভূলুণ্ঠিত হবে।

তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে কয়েকজন দাগী আওয়ামী দোসর বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীদের ব্যবহার করে জামিন নিয়েছে। আদালতও জামিনের ক্ষেত্রে হালকা মনোভাব দেখাচ্ছে। সহজেই জামিন দিয়ে দিচ্ছে। আদালত এভাবে সহজে জামিন দিয়ে দিলে বিরোধীতাকারী আইনজীবীদের করার কিছু থাকেনা। 

তিনি বলেন,  বিচার ব্যবস্থায় এখনো আওয়ামী দোসর ঘাপটি মেরে রয়েছে। বিচারকদের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে, আওয়ামী দোসরদের ইশারায় কক্সবাজার আদালত চলছে। পুলিশ এজাহারনামীয় আসামি না ধরে যে কাউকে ধরে অজ্ঞাত মামলায় চালান দিচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেন এ আইনজীবী।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা বলছেন, যেভাবে বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীর স্বৈরাচারের দোসরদের জামিন নিয়ে দিচ্ছে তা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ও বিপজ্জনক। এভাবে যদি আন্দোলনে হামলাকারী ও হত্যাকারীরা পার পেয়ে যায় তাহলে আমাদের ভাইদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। আর যদি কোনো হাসিনার দোসরদের জামিন পেতে সহায়তা করা হয় তাহলে আমরা বসে থাকবো না।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরী বলেন, গণ-আন্দোলনের ছাত্রজনতার উপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোতে শীর্ষ অনেক  গ্রেফতার হয়েছে। একই সাথে এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত অনেক আসামীকে আমরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। আরও যারা আসামি রয়েছে বা হামলার সাথে জড়িত রয়েছে তাদের গ্রেফতারে আমাদের বিশেষ অভিযান জোরদার হয়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন থানায় আসামী গ্রেফতার করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, জেলার সব থানায় নতুন কর্মকর্তা ও নতুন পুলিশ সুপার যোগ দেয়ার পর থেকে পুলিশের কাজে গতি ফিরেছে। আমরা নবউদ্যোমে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি, ট্রাফিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। ছাত্র জনতার 'রক্তস্নাত' বিজয় কোনভাবেই ম্লান হতে দেয়া যাবেনা বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।