চাঁদপুর জেলার সিকিকোটি মানুষজন দিন পার করছে আতংকের মধ্যে
৯০ ভাগ অগভীর নলকুপে মাত্রা অতিরিক্ত আর্সেনিক সনাক্ত
প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০:০২ | অনলাইন সংস্করণ
চাঁদপুর প্রতিনিধি
আর্সেনিক বিশেষজ্ঞদের মতে ও তাদের জরিপে দেখা গেছে,বাংলাদেশের বিভিণœ জেলার মত আর্সেনিক প্রবল এলাকার তালিকা হিসেবে চাঁদপুর জেলাকে অন্যতম জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিগত বছরে দেখা যায়,দেশের বিভিন্ন এনজিও গুলো বিশেষ সেবাদান হিসেবে মানুষের কল্যানে বিভিন্ন জেলায় এ আর্সেনিক থেকে রক্ষা পেতে বিনামূল্যে এ ধরনের রোগীদের পরীক্ষা নিরীক্ষাসহ ঔষধ প্রদান করে তাদের সহায়তা দিতো। সে সব এনজিও গুলো সরকারের বিভিন্ন অসহযোগিতার কারনে এবং এ সব এনজিও গুলোর মধ্যে অনেকের কার্যক্রমে ভাটা দেখা দেওয়ায় সময়ের ব্যবধানে সে কার্যক্রম একেবারে বন্ধ করে দিযেছে তারা।
এতে করে আর্সেনিক আক্রান্ত রুগীরা চিকিৎসা না পাওয়ায় এ রোগ আরো দ্রæত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে ও মানুষের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা সৃষ্টি হয়ে বাড়তে থাকে এ আর্সেনিক রুগীর সংখ্যা।
চাঁদপুরের জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, জেলায় পরীক্ষা করা গভীর নলকুপে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া না গেলেও প্রায় ৯০ ভাগ অগভীর নলকুপে সনাক্ত হয়েছে মাত্রা অতিরিক্ত আর্সেনিক। গভীর নলকুপ সরবরাহের পাশাপাশি পরিশোধিত নদীর পানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা গেলে কমে আসবে এ আর্সেনিকের ঝুঁকি ও নিরাপদে থাকবে মানুষ। আর এ বিষয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কাজ করা হবে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে।
চাঁদপুরে সর্বপ্রথম ১৯৯৬ সালে শাহরাস্তি উপজেলায় সনাক্ত হয় আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী। এর পর ১৯৯৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ আর্সেনিক প্রবল অঞ্চল হিসেবে এই উপজেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের কারণে নীরব এই ঘাতক রোগে আক্রান্ত হতে থাকেন জেলার হাজার-হাজার মানুষজন।
তাদেরই একজন শাহরাস্তি উপজেলার আয়নাতলী গ্রামের বাসিন্দা মীর হেলাল উদ্দিন। ২০০৫ সালে তিনি আর্সেনিকে আক্রান্ত হন। ২০০৮ সালে পরীক্ষা করে জানতে পারেন তার দুটি কিডনিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ আর্সেনিকের প্রভাবে। এতো বছর পর এখনো হাত, পা-পেটসহ শরীরজুড়ে আর্সেনিকের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে জানান দিচ্ছে কালো কালো দাগ।
তিনি বলেন, আর্সেনিক আক্রান্ত হওয়ায় শারীরিকভাবে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে চিকিৎসা করে আসছি। এতে অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে সময়ের ব্যবধানে আর্সেনিকমুক্ত নলকুপ ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অনেকে এখনও আর্সেনিক নেই মনে করে কলের পানি পান করছেন। এটা ঠিক না। আর্সেনিক নিয়ে সচেতন না থাকলে একটা সময় পর এর জন্য মূল্য চুকাতে হবে।
শাহরাস্তি উপজেলার ঠাকুর বাজার এলাকার বাসিন্দা মো. ফয়েজ আহমেদ বলেন, আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে শাহরাস্তি পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তালুকদার বাড়ির একই পরিবারের ৩ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। এখনও অনেকে আক্রান্ত অবস্থায় রয়েছেন। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে সরকারিভাবে ঔষধ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর্সেনিক পরীক্ষায় অনীহা বেড়েছে অনেক মানুষের মধ্যে। এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. সারোয়ার হোসেন বলেন, জেলার সবচেয়ে বেশি আর্সেনিকপ্রবণ উপজেলা শাহরাস্তি। আমরা প্রতিনিয়ত আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী পেলেও আশার কথা হচ্ছে তা আগের তুলনায় অনেক কম। আমরা মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আর্সেনিকমুক্ত পানি পানের জন্য আহব্বান জানাই। আগে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণ করা হলেও বেশ কয়েক বছর তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে না বলে জানান এ শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।
চাঁদপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, মূলত উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে এ চাঁদপুরে। এর ভয়াবহতা অনুধাবন করে আর্সেনিকমুক্ত পানি পানের লক্ষ্যে শুরু করা হয় নলকুপের পানি পরীক্ষা। ২০১১-১২ অর্থ বছর থেকে শুরু হয় সরকারিভাবে গভীর নলকুপ বসানোর কাজ। বিভিন্ন পৌরসভায় সরবরাহ করা হয় পরিশোধিত নদীর পানি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধাতির মানদন্ড অনুযায়ী প্রতি লিটার পানিতে .০১ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিক থাকলে তা খাবারের জন্য নিরাপদ। তবে বাংলাদেশ সরকারের মানদÐ অনুযায়ী প্রতি লিটারে .০৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিক থাকলে তা খাবারের জন্য নিরাপদ। তার ঊর্ধ্বে থাকলে তা অনিরাপদ ও পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।।
জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌলশ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু মুসা মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, ২০২২ সালে একটি গবেষণা কার্য পরিচালনা করা হয়। এতে জেলার ২ লক্ষ ৫ হাজার ৭০টি নলকুপের পানি পরীক্ষা করে দেখা যায়, এসব নলকুপের ৬০ শতাংশ অগভীর এবং বাকি ৪০ শতাংশ গভীর নলকুপ। গবেষণায় গভীর নলকুপে আর্সেনিক পাওয়া না গেলেও অগভীর নলকুপের প্রায় ৯০ শতাংশে .০৫ এর বেশি আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক জলাধারের পানিতে আর্সেনিক কিংবা আয়রন থাকে না। আর চাঁদপুর যেহেতু নদীবেষ্টিত জেলা, তাই গ্রামীণ এলাকায় গভীর নলকুপের পাশাপাশি পরিশোধিত নদীর পানি সরবরাহ বৃদ্ধি করা গেলে আর্সেনিক থেকে এই অঞ্চলের মানুষ নিরাপদ থাকতে পারবে।
তিনি বলেন, জেলায় ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২২ হাজার গভীর নলকুপ স্থাপন করা হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় এক হাজার টিউবয়েল ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের সিভিল সার্জন নূর আলম দ্বীন বলেন, দীর্ঘ সময় আর্সেনিকযুক্ত পানি পানে চর্ম রোগ, টিউমার, কিডনি, লিভারের রোগসহ ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। তাই নিশ্চিত না হয়ে কোনও টিউবয়েলের পানি পান করা উচিত না। যদিও গত কয়েক বছর ধরে এই রোগে আক্রান্তদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় হয়তো এই কাজে আমাদের ভাটা পড়েছে। আশাকরি এখন থেকে আক্রান্ত রোগীদের তথ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে আর্সেনিকের ওপরে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। যাতে করে আর্সেনিকের বিষয়ে আরও সচেতন থাকতে পারে এ জেলার সিকি কোটি মানুষজন।