সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে ‘পর্যটক সীমিতকরণ ও রাত্রিযাপন নিষিদ্ধসহ বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের’ দাবিতে ভাড়াটে লোকজন নিয়ে কক্সবাজার শহরে এসে সড়ক অবরোধ করে মানবন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচী পালন করেছে দ্বীপের বাসিন্দারা। এসময় দ্বীপের বাসিন্দারা কাফনের কাপড় পড়ে সড়কে শুয়ে পড়েন।
মঙ্গলবার বেলা ১১ টা থেকে কক্সবাজার শহরের প্রবেশমুখ কলাতলীর ডলফিন মোড়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দাদের উদ্যোগে এ কর্মসূচী শুরু হয়। ১২ টার দিকে আন্দোলনকারিদের সাথে আলোচনার জন্য ঘটনাস্থলে এসেন কক্সবাজার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নীলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী ও কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসীম উদ্দিন চৌধুরী সহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। টানা আলোচনার পর প্রশাসনের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ৫ ঘন্টা পর বিকাল ৪ টার দিকে অবরোধ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারিরা।
অভিযোগ উঠেছে, দেশান্তরীন স্বৈরাচারী শেখ রেহেনার আস্তাভাজন একটি চক্র সরকারের সিদ্ধান্তকে ভূলন্ঠিত করার জন্য এই চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। চক্রটি গত ১৫ বছরে পর্যটন ব্যবসায় তাদের মনগড়া সিদ্ধান্তের বাহিরে কেউ কথা বলতে দেয়নি। এমনকি চক্রটি পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ চালিয়ে আসছিল।
এদিকে সকাল ১১ টার কলাতলী মোড়টি শহরের অত্যন্ত ব্যস্ততম এলাকা এবং প্রবেশমুখ হওয়ায় অবস্থান কর্মসূচীর কারণে চতুর্দিকে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে শত শত যানবাহন আটকা পড়ায় পর্যটক ও স্থানীয়রা দুর্ভোগে পড়েন। যার কারনে সাধারণ মানুষের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এমনকি আন্দোলনের নামে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের কারনে পর্যটকদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা আব্দুল মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্টিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা ও পর্যটন ব্যবসায়ি মাওলানা আব্দুর রহমান খান, মোহাম্মদ আলম, সরওয়ার কামাল, ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) একাংশের সভাপতি রেজাউল করিম সহ অনেকে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) মো. ইয়ামিন হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আন্দোলনকারীদের একটা প্রতিনিধি দলের সাথে জেলা প্রশাসক মহোদয় বসেছিলেন। এসময় তাদেরকে আশ্বস্ত করা হয়েছে তাদের দাবি-দাওয়াগুলো উপদেষ্টা মহোদয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। বৈঠকের পরপরই আন্দোলনকারীরা সড়ক অবরোধ তুলে নেয়।
কক্সবাজার ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা মুফিজুর রহমান বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটক ভ্রমণে বিধি-নিষেধ পুণর্বিবেচনা চাই তবে এভাবে রাস্তা বন্ধ করে পর্যটকদের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে করা কোন আন্দোলনকে আমরা সমর্থন করিনা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাড়াটে লোক এনে সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন কোন ভাবে মেনে নেয়া যায়না। মুলতঃ কতিপয় হোটেল মালিক এ আন্দোলনের উস্কানি দিচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে তাদের উস্কানিমূলক পরিকল্পিত আন্দোলন কক্সবাজারের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাইনয়, এতে করে কক্সবাজারে পর্যটকও কমে যাচ্ছে।
এদিকে এ আন্দোলনকে ঘিরে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে।
আসাফউদ্দৌলা আশেক নামের একজন লিখেছেন, জীবন-জীবিকার অধিকার নিয়ে আন্দোলন করার অধিকার সবার রয়েছে।
অপরদিকে এডভোকেট মুজিবুল হক নামের একজন লিখেছেন, রাস্তা অবরোধ করে জনগণকে জিম্মি করে কিসের আন্দোলন। রাস্তায় হাজার গাড়ি আটকা পড়েছে। আন্দোলনের একটা শৃঙ্খলা থাকা উচিত।
কক্সবাজারের সিনিয়র সাংবাদিক, গবেষক আহমদ গিয়াস লিখেছেন, সেন্টমার্টিনের একদল মানুষ তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য কক্সবাজারে এসে শহরের কলাতলী, মেরিন ড্রাইভসহ শহরের একাংশের মানুষকে জিম্মি করে ফেলেছে। তাদের সড়ক অবরোধের কারণে স্কুলগামী শিক্ষার্থী ও হাসপাতালগামী রোগীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছে। জরুরী কাজে শহরের একাংশ থেকে অপর অংশে চলাচল করতে পারছে না। এটা আন্দোলনকারীদের একটি ক্রাইম। ওরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে বাধাহীন বা স্বাভাবিক চলাফেরায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, অধিকার লঙ্ঘন করছে। সেন্টমার্টিন কি কলাতলী থানার অধীনে যে এখানে এসে কর্মসূচি পালন করতে হবে? নিশ্চয় কলাতলীর কেউ তাদের ইন্ধন দিচ্ছে, নব্য নেতার হওয়ার খায়েসে! এই ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হোক। এইচ এম নজরুল ইসলাম লিখেছেন, জীবনে যারা সেন্টমার্টিনে যায়নি তারাও দেখি সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা পরিচয়ে আন্দোলন করছে।
কক্সবাজার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নীলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী জানিয়েছেন, দ্বীপের বিষয় নিয়ে ঢাকায় বৈঠক চলছে। বিষয়টি তাদের অবহিত করা হয়েছে। আন্দোলনের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহলকে অবহিত করা হয়েছে। দ্রুত দ্বীপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানানোর পর আন্দোলনকারিরা অবরোধ প্রত্যাহার করেছেন।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসীম উদ্দীন চৌধুরী জানান, বিকাল ৪ টার পর থেকে সড়ক অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক।
প্রসঙ্গত, গত ২২ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রাণলয়ের সভায় সেন্টমার্টিনের বিষয়ে নানা বিধি নিষেধ আরোপ করে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে গত ২৮ অক্টোবর একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব অসমা শাহীন স্বাক্ষরিত একটি পরিপত্র জারি করে। যে পরিপত্রে ৫ টি বিষয় উল্লেখ্য রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে সেন্টমার্টিনে নৌ যান চলাচলের বিষয়টি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি গ্রহণ করে অনুমতি প্রদান করবে। নভেম্বর মাসে দ্বীপে পর্যটক গেলেও দিনে ফিরে আসতে হবে। রত্রিযাপন করতে পারবেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রাত্রিযাপন করা যাবে। পর্যটকের সংখ্যা গড়ে প্রতিদিন ২ হাজারের বেশি হবে না। দ্বীপে রাতে আলো জ্বালানো যাবেনা, শব্দ দূষণ সৃষ্টি করা যাবে না। বার বি কিউ পার্টি করা যাবে না। এমন সিদ্ধান্তকে অযুক্তিক দাবি করে কর্মসূচীতে দ্বীপবাসীর পাশাপাশি হোটেল-মোটেল, রেঁস্তোরা ও ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন সহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহস্রাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারি ও কর্মিরা অংশগ্রহণ করেন।