রংপুর বিভাগে নদী, খাল, বিল এবং পুকুরের মতো অন্যান্য বিলুপ্ত জলাধার পুনঃখননের ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উন্নতি হচ্ছে। এমন পদক্ষেপে প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি জলাধারগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে অবদান রাখছে। পাশাপাশি কৃষি ও গৃহস্থালীর কাজে এসব পানি ব্যবহার করা হচ্ছে।
জলাধার পুনঃখনন করায় শত শত নারী-পুরুষ এবং সাধারণ মানুষ ব্যাপক লাভবান হচ্ছেন। একইসঙ্গে পুনঃখননকৃত জলাধারগুলোর পাড়ে কৃষি, মৎস্য চাষ, বৃক্ষরোপণ, শাক-সবজি চাষ সহজতর হয়ে ওঠেছে।
তারা গবাদি পশুকে খাওয়ানোর জন্য নেপিয়ার ঘাস চাষ করছেন। চারপাশে সবুজের মাঝে জীবনযাত্রার উন্নতি করতে হাঁস পালন করে ভাগ্য পরিবর্তন করছেন।
‘ভূ-উপরস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তম রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ’ (ইআইআর) প্রকল্প (২০১৯-২০২৫) বাস্তবায়ন এই ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোকে সম্ভব করে প্রকল্প এলাকায় একটি সুন্দর ও মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য তৈরি করেছে।পুনঃখননকৃত জলাধারের থৈ থৈ স্বচ্ছ জলাবদ্ধ এলাকা এবং তীরের বনাঞ্চল এখন স্থানীয় এবং অতিথি পাখির কিচিরমিচিরসহ হারিয়ে যাওয়া বিরল প্রজাতির কাঠ ও ঔষধি গাছ এবং ফুলের গাছে ভরপুর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য সকলকে আকৃষ্ট করছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলার ৩৫টি উপজেলায় ২৮৮.১১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
সম্প্রতি বাসসের সাথে আলাপকালে প্রকল্প এলাকার কৃষক, গ্রামবাসী এবং গৃহিণীরা জানান যে তারা প্রকল্পের ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব এবং তিন থেকে চার দশক পর আবার নতুন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যসহ হারিয়ে যাওয়া বাস্তুতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন প্রত্যক্ষ করছেন।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বড় বদনাপাড়া গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ কায়কোবাদ জানান, বিলুপ্ত চতরা খাল পুনঃখননের ফলে চাষের জমিগুলো জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়েছে। কৃষকরা এসব জমিতে এখন বছরে তিনটি ফসল চাষ করতে সক্ষম হচ্ছেন।
কায়কোবাদ বলেন, অনেক কৃষক, পুরুষ ও মহিলা বিভিন্ন জলাধারের পাড়ে সবজি, কলা ও নেপিয়ার ঘাস চাষ করছেন এবং উন্নত জীবিকা অর্জনের জন্য পুনঃখনন করা খালে হাঁস পালন করছেন এবং বিলুপ্ত প্রজাতির দেশী জাতের মাছ ধরে নিজেদের পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটাচ্ছেন।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ভগবানপুর গ্রামের কৃষক বাদশা মিয়া জানান, বিলুপ্ত শালমারা খাল পুনঃখননের ফলে তার তিন একর জমি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়েছে। তিনি এখন উন্নত পরিবেশে ঐ জমিতে বছরে তিনটি ফসল চাষ করতে সক্ষম হচ্ছেন।
একই উপজেলার বেতগাড়া গ্রামের গৃহবধূ নুর সালমা বলেন, ষষ্ঠীছড়া বিল পুনঃখনন করে পাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির চারা রোপণ করায় সবুজায়নের পাশাপাশি পরিবেশের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন ও উন্নতি হয়েছে এবং এতে করে স্থানীয় শত শত মানুষ উপকৃত হচ্ছেন।
এ সময় আনন্দচিত্তে সালমা বলেন, বিলটি পুনঃখননের ফলে স্থানীয় লোকজন সেখানে সঞ্চিত পানি সেচ ও গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার করতে পারছেন, পাড়ে নেপিয়ার ঘাস ও শাক-সবজি চাষ, হাঁস পালন ও স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানিতে গোসল করতে পারছেন।
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার ঝাড়পাড়া গ্রামের গৃহবধূ হোসান্না বেগম জানান, তিন বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মড়া তিস্তা নদী পুনঃখননের পর থেকে তিনি হাঁস পালন এবং কলা ও সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
একই উপজেলার বক্সীগঞ্জ কুঠিপাড়া গ্রামের গৃহবধূ জিলাপী বালা ও শেফালী খাতুন জানান, বিলুপ্তপ্রায় ঘিরনই নদী পুনঃখনন ও তার তীরে ব্যাপক বনায়নের ফলে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের উন্নতি হয়েছে । এটা যেনো তাদের জন্য এক স্বর্গীয় আশীর্বাদরূপে দেখা দিয়েছে।
পাশের কুঠিপাড়া গ্রামের জেলে রমজান আলী, আবু তাহের, মোহাম্মদ হামীম ও মোহাম্মদ তুহিন জানান, তারা পুনঃখনন করা ঘিরনই নদীতে বিলুপ্ত বিভিন্ন প্রজাতির দেশী জাতের মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সেখানে পুনঃখনন করা ঘিরনই নদীর পাড়ে গাছের চারা রোপণে প্রকৃতি সবুজ হয়ে উঠেছে।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার চর বেরুবাড়ি গ্রামের কৃষক আব্দুল হালিম ও মকবুল হোসেন জানান, বিলুপ্ত বোয়ালেরদাড়া খাল পুনঃখননের ফলে তাদের আবাদি জমি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়েছে। তারা চার দশক পর এখন সেখানে বছরে তিনটি ফসল চাষ করতে সক্ষম হচ্ছেন।
স্থানীয় মানুষ ফসলের ক্ষেতে সেচ, হাঁস পালন, মাছ চাষ এবং গৃহস্থালি কাজে সংরক্ষিত পানি ব্যবহার করছেন।
ইআইআর প্রকল্প পরিচালক এবং বিএমডিএ-এর রংপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান খান বাসসকে বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে প্রকল্প এলাকার হাজার হাজার মানুষ পুনরুজ্জীবিত বাস্ততন্ত্র এবং উন্নত পরিবেশে ব্যাপক সুফল পেতে শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব মোকাবেলা করতে এবং সংরক্ষিত ভূ-পৃষ্ঠের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার, বনায়ন এবং স্থানীয় ও অতিথি পাখিদের জন্য হারিয়ে যাওয়া বাস্ততন্ত্র এবং অভয়ারণ্যগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি কৃষিকে আরো উন্নত করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।