ঢাকা ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শখের নার্সারী থেকে এখন বছরে সঞ্চয় লাখ টাকা

শখের নার্সারী থেকে এখন বছরে সঞ্চয় লাখ টাকা

মেধা, শ্রম আর ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে কোন কাজেই সফলতা অর্জন সম্ভব। এমনি এক বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন শেরপুরের নকলা পৌরসভার ধুকুড়িয়া এলাকার নার্সারী ব্যবসায়ী মোক্তার হোসেন। শখের বসে প্রথমে বাড়ির আঙ্গীনায় ফুলের নার্সারী করলেও এখন বাণিজ্যিকভাবে ফুল ও ফলের চারার নার্সারী করে তিনি স্বাবলম্বী হয়েছেন। হয়ে উঠেছেন একজন সফল নার্সারীর মালিক। সংসারে ফিরে এসেছে স্বচ্ছলতা। এখন বছরে তার সঞ্চয় হয় লাখ টাকা। নার্সারীর সফল মালিক হিসেবে তার পরিচিতি এখন উপজেলা ছাড়িয়ে জেলাতে ছড়িয়ে পড়েছে। নার্সারীর জন্যই এক নামে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। তার দেখাদেখি উপজেলায় দিন দিন এই ব্যবসায়ীর সংখ্যা ও পরিমাণ বাড়ছে।

মোক্তার হোসেনের সফলতা দেখে নার্সারীতে বিনিয়োগ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে উপজেলার অর্ধশত পরিবার। ভ্যানে করে ফুল, ফলের চারা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন আরও অন্তত ত্রিশ পরিবার। রাজধানী ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী জেলা গুলোতে যাচ্ছে এখনকার নার্সারীর চারা ও ফুল। যদিও সহজ লভ্য নয় এমন কিছু উন্নত জাতের ফুল ও ফলের চারা অন্য জেলা থেকে তাদের আনতে হয়। উপজেলার ছোট বড় সব বাজারেই তাদের নার্সারীর চারা ও ফুল বেচাকেনা হয়।

ফুল এবং ফুল-ফলের চারা বিক্রেতাদের অনেকেই জানান, সারা বছর যতটা না ফুল ও ফুলের চারা বিক্রি হয়, তারচেয়ে অনেক বেশি বিক্রি হয় ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারীর ২১ তারিখ পর্যন্ত। তাছাড়া বিশেষ দিন গুলোতেও তাদের ফুলই উপজেলাবাসীর একমাত্র ভরসা।

সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার ধুকুড়িয়া, রামপুর, কবুতরমারী, বাউসা, কায়দা, মোজার, পুলাদেশী ও মাউড়াসহ বেশ কিছু গ্রামের অন্তত শতাধিক পরিবার এই পেশায় জড়িয়ে জীবীকা নির্বাহ করছেন। কেউ পানি দিচ্ছেন, কেউ আগাছা দমন বা কীটনাশক দিচ্ছেন, কেউবা বিভিন্ন চারা ভ্যানে সাজিয়ে গ্রাম গঞ্জে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছেন।

মোক্তার হোসেন জানান, ভ্যানে করে ফুল ও গাচের চারা বিক্রি করে দৈনিক ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত তাদের। আয় হয়। ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ চারা বিক্রি করছেন, আবার কেউ পছন্দের চারাগাছ কিনতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সবাই যেন নিজেদের বাড়ীকে লাল সবুজে সাজাতে ব্যস্ত।

তিনি জানান, উপজেলার অধিকাংশ নার্সারীতে গোলাপ, গাদা, মৌচান্দা, মাদবী লতা, জুঁই, চামেলী, শিউলী, কামিনি ফুলসহ বিবিন্ন জাতের গাছের বিক্রি করা হয়। তবে মোক্তার হোসেনের নার্সারীতে বিভিন্ন জাতের গোলাপ, গাদা, ডাবল ও সিংগেল স্টার, বার্ডিং হার্ট, বাগান বিলাশ, ক্রিশমাশ, দোপাটি, চন্দ্রমল্লিকা, ডাবল ও সিংগেল রঙ্গন, মৌচান্দা, মাদবী লতা, জুঁই, চামেলী, শিউলী, কামিনি, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, সেঞ্চুরী, গন্ধরাজ, বিভিন্ন জাতে জবা, সেলবিয়া, জিনিয়া, কসমস, ক্যাবিস্ট, মিনি ও বড় টগর, ক্যালেন্ডুলা, ডালিয়া, হাসনা হেনা, চায়না ও ভারত থেকে আনা অ্যানকাসহ নানান প্রজাতির ফুল ও ফুলের চারা এবং সাথী চারা হিসেবে উন্নত জাতের বিভিন্ন প্রকার আম, পেপে, কাঁঠাল, লিচু, থাই পেয়ারা, ডালিম, জাম্বুরা, মেহেদীর চারা তৈরি ও বিক্রি করা হয়। গাছের জাত বিবেচনায় প্রতিটি চারা ২০ টাকা থেকে ২,৫০০ টাকা করে বিক্রি করেন তিনি। ফলের চারা থেকেও বাড়তি টাকা আয় হয়। এ আয় দিয়ে মোক্তারের মত অনেকেই বাড়ী করেছেন, কিনেছেন জমি। ছেলে মেয়ের পড়া লেখার খরচসহ সংসারের অন্যান্য খরচ এই নার্সারী থেকেই পাচ্ছেন তারা।

নার্সরীর মালিক মোক্তারের বলেন, আগে ধান, গম, পাটসহ অন্যান্য ফসল চাষ করে প্রায়ই লোকসান গুনতে হত। তাই ১৯৯৮ সালে বাড়ীর আঙ্গীনায় ফলজ ও কাঠ গাছের নার্সারী স্থাপন করি। প্রথম বছরেই বেশ লাভ হয়। পরের বছর থেকে নার্সারীর জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করায় বর্তামানে আড়াই একর জমিতে নার্সারী গড়ে ওঠেছে। এরমধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ জমিতে বিভিন্ন ফুলের নার্সারী করেছেন তিনি। সে নিজের ৫০ শতাংশসহ আরও দুই একর জমি বন্ধক নিয়ে সেখানে নার্সারী করেছেন। এবার তার নার্সারীতে প্রায় তিন লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এই নার্সারী থেকে এবছর ৬ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকার চারা বিক্রে করতে পারবেন বলে তিনি আশা করছেন। সব আয়-ব্যয় শেষে এবছর তার লাখ টাকা সঞ্চয় হবে এমনটাই জানান তিনি।

ভ্যানে করে ফুলের চারা বিক্রেতা সাদির, চানু, মোক্তারসহ কয়েকজন জানান, প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে ভ্যানেকরে ফুলের চারা বিক্রি করেন তারা। তারা বলেন, শিক্ষার্থীরা ফুলের চারা বা ফুল বেশি কিনেন। তবে বর্ষা মৌসুমে কাঠ ও বিভিন্ন জাতের ফলের গাছ বেশি বিক্রি হয়। এসময় সব শ্রেণির মানুষ গাছের চারা কিনেন। তারা জানান, ফুল হাতে শিশু কিশোর ও ছাত্রদের হাসিমাখা মুখ এবং সুজলা সুফলা গ্রামীণ সৌন্দর্য তাদের ভালো লাগে। তার চেয়ে বেশি ভালো লাগে যখন কেউ বলেন আপনার কাছ থেকে চারা নিয়ে লাগানো গাছে ফলন এসেছে।

নার্সারী ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য মতে, রামপুরের সাদির মিয়া, চাঁনু, লাল মিয়া, লিয়াকত আলী ও শরিফ; ধুকুড়িয়ার মোক্তার হোসেন, উক্কা, রুস্তম, তাহের ও বারেক; কবুতরমারী এলাকার আবুল কাশেম, রফিক, কাশেম ও আক্কাস আলী, মমিনাকান্দা এলাকার ইমান আলীর মতো অনেকেই এখন বড় আকারের নার্সারীর মালিক। সাবার নার্সারীতে ফুলের চারা রয়েছে। চাঁনু ও উক্কা বলেন, এই ব্যবসায় বিনিয়োগের তুলনায় দ্বিগুন লাভ পাওয়া যায়। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি, মার্চ, আগষ্ট, ডিসেম্বর মাসে ফুল ও ফুলের চারার চাহিদা বেশি থাকে। তাই অল্প জমির মালিকরা মৌসুমী ফুল চাষের পেশায় ঝুঁকছেন।

উপজেলা নার্সারী মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ মোক্তার হোসেন জানান, ২০১৩ সালে এক বীজ কোম্পানীর মাধ্যমে উপজেলার ৫ জন নার্সারীর মালিক যশোরে নার্সারী বিষয়ে ৩ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তাতে ভালো সুফলও পেয়েছেন তারা। প্রশিক্ষণ লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নার্সারী ব্যবসা করে আজ তারা সবাই স্বাবলম্বী হয়েছেন।

উপজেলা নার্সারী মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম জানান, সরকারি পৃষ্টপোষকতায় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে, নার্সারী ব্যবসার মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রাক্ষার পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হতো। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ইমান আলী বলেন, নার্সারী না থাকলে দেশটা এত অল্প সময়ের মধ্যে সবুজ শ্যামল হয়ে উঠত না। আমাদের নার্সারীর চারাতেই উপজেলার অধিকাংশ কাঠ ও ফলের বাগান গড়ে উঠেছে।

এবষিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী বলেন, নার্সারীর উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণে কৃষি বিভাগ থেকে নিয়মিত ও প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা নিয়মিত দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, নকলা উপজেলায় ছোট বড় প্রায় অর্ধশত নার্সারী রয়েছে। এতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। নকলা উপজেলার নার্সারীর মালিকরা আজ সবাই স্বাবলম্বী। মেধা, শ্রম আর ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যেকেউ নার্সারী ব্যবসাতে স্বাবলম্বী হতে পারেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

শখের নার্সারী,বছরে সঞ্চয়,লাখ টাকা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত