পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম আব্দুল আওয়াল বলেন, ১৭ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট সরকার ইচ্ছামত রাষ্ট্র পরিচালনা করে দেশকে শেকলবন্দি করে ফেলেছিল। মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়ে দেশকে কলুষিত করেছিল।
সোমবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের স্মরণে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবিপ্রবি) স্মরণসভা অনুষ্ঠানের আহবায়ক অধ্যাপক ড. মোঃ আমিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
উপাচার্য বলেন, ৭১ এ দেশ স্বাধীন হলেও মানুষ স্বাধীনতার সুফল পায় নাই। শুধু কোটার জন্য ছাত্ররা আন্দোলন করে নাই। শেকল ভেঙ্গে দেশ, জাতি- মানুষের মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল সবার কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি নিয়ে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। স্বৈরাচারকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। আন্দোলনকারীরা জাতির মহানায়ক। এই আন্দোলন করতে গিয়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শহিদ হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগে ২০২৪ সালে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। দেশ প্রকৃতভাবে স্বাধীন হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ইতিহাস, তাদের অবদান জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। শহিদ ও আহতদের ইতিহাস, তাদের পরিবারের কথা মানুষকে জানাতে হবে। নইলে এই আন্দোলন হারিয়ে যাবে। ব্যর্থ হয়ে যাবে।
অধ্যাপক আব্দুল আওয়াল বলেন, আমরা এই দেশটাকে, এই আন্দোলনটাকে ধারণ করি। ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে গর্ব করি। তাদের গল্প, সত্যিকার ইতিহাস বিশ্ব্বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হবে। তাদের ইতিহাস আমরা বিলীন হতে দিতে পারি না। তাদের ত্যাগের আদর্শকে সামনে রেখে দেশকে নতুন করে গড়া তোলা হবে। আমরা সেই বাংলাদেশ দেখতে চাই- বিশ্বে মাথা উচু করে দাড়াবে। যে উদ্দেশ্যে শহিদ ও আহতরা আন্দোলনে গিয়েছিলেন তা আমরা অর্জন করব। শহিদ ও আহত এবং তাদের পিতামাতার দুঃখ কষ্টের কথা আমরা স্মরণে রেখে আধুনিক নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলব। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার সংবেদনশীল, পর্যায়ক্রমে তারা শহিদ ও আহতদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমরাও বিশ^বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাদের পাশে আছি- থাকব।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ নজরুল ইসলাম ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় নিজের সংশ্লিতা সম্পর্কে বলেন, সে সময় খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমার বাড়িতে থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। তাদেরকে শারিরীক- মানসিক- আর্থিকভাবে সাহায্য করেছি। এই আন্দোলনে অনেকে রক্ত দিয়ে, অর্থ দিয়ে, সময় দিয়ে ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তারা সবার সম্মানপ্রাপ্য। ছাত্র-জনতা যে উদ্দেশ্য নিয়ে ত্যাগ স্বীকার করেছে আমাদের দায়িত্ব হল তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করা।
স্মরণসভায় শহিদ মাহাবুব হাসান নিলয়ের বাবা আবুল কালাম আজাদ বলেন, খুনীদের বিচার না হলে জাতি হিসেবে আমরা কলংকিত হব। এর দ্বায় সবার। নইলে আমরা ঋণমুক্ত হতে পারব না। শহিদ জুলকার নাইনের বাবা আব্দুল হাই আল হাদি বলেন, আমার সন্তান ন্যায়ের জন্য শহিদ হয়েছে। এখন আমরা কোন বিভেদ না করে লোভ লালসার উর্ধ্বে ওঠে সবাই দেশের জন্য কাজ করব।
শহিদ জাহিদুলের বাবা দুলাল উদ্দিন বলেন, শহিদদের উদ্দেশ্য যেন সফল হয়। দেশের জন্য যেন আর কাউকে রক্ত দিতে না হয়। শহিদ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী মনজিলা খাতুন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমার স্বামী সাধারণ মানুষ হয়েও দেশ প্রেমিক ছিলেন। তাই আন্দোলনে গিয়েছিল। সে ছিল পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম। তাকে হারিয়ে দুই সন্তান নিয়ে আমি নিঃস্ব।
আহতদের মধ্যে বক্তব্য দেন পেটে গুলিবিদ্ধ শ্রমিক আরাফাত হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আহত ছাত্র মাসুম হোসেন, সানোয়ার হোসেন সনি, তাহসিন আহমেদ, সমন্বয়ক মনজুরুল ইসলাম, মিরাজুল ইসলাম এবং শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক ড. মোঃ কামরুজ্জামান, প্রক্টর অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান খান, শিক্ষক সাইমুন নাহার রিতু, ইমরান হোসেন ও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন।
চার শহিদের পরিবার ও আহতরা এসময় উপস্থিত ছিলেন। স্বজনরা শহিদদের আত্মত্যাগের কথা এবং আহতরা আন্দোলনের সময় নির্যাতনের বর্ণনা দেওয়ার সময় পুরো মঞ্চ জুড়ে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। জাতীয় সঙ্গীত ও ধর্মগ্রন্থ পাঠের পর অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর শহিদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। শহিদ ও আহতদের জন্য দোয়া করা হয়।
স্মরণ সভায় শহিদ পরিবারের সদস্য ও আহতদের হাতে আর্থিক সহায়তার চেক তুলে দেওয়া হয়। এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে সম্মাননা জানানো হয়।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে রোজিনা খাতুন ও সেজানের সঞ্চালনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।