শস্য ভান্ডার খ্যাত শেরপুরের নকলায় এ বছর আগাম ও উন্নত জাতের বেগুনের বাম্পার ফলনের পাশাপাশি ভালো দাম পেয়ে কৃষকরা খুশি। এখানকার উৎপাদিত বেগুনের গুণগতমান ভালো ও নিরাপদ হওয়ায় স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিঠানোর পাশাপাশি সরবরাহ করা হচ্ছে ময়মনসিংহ ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরে।
স্থানীয় বাজারগুলোতে প্রতি সপ্তাহে নজিরবিহীন বেগুন বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষক ও সবজির পাইকাররা। সবজি চাষে ভাগ্য বদলে গেছে নকলার চরাঞ্চলের শতাধিক পরিবারের। তাদের পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা; সবাই হয়েছেন আত্মনির্ভরশীল।
এবার উপজেলায় মোট ২,০০১ হেক্টর জমিতে সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানের উৎপাদিত সবজি অপেক্ষাকৃত গুণগত মানসম্পন্ন ও অধিকতর নিরাপদ হওয়ায় স্থানীয় বাজার গুলোতে এই সবজির চাহিদা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ভালো দাম পাচ্ছেন কৃষকরা।
বাম্পার ফলন ও দাম ভালো পাওয়ায় বেগুন চাষের মাধ্যমে সর্বোচ্চ যারা ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন তাদের মধ্যে চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের চর বাছুরআলগা গ্রামের সোলায়মান হোসেন ও নূর মোহাম্মদ, চরখারচর এলাকার সীজল মিয়া ও নূর বকত অন্যতম। সোলায়মান হোসেন ৩ একর জমিতে, নূর মোহাম্মদ ২ একর, সীজল মিয়া দেড় একর ও নূর বকত এক একর জমিতে উন্নত জাতের আগাম বেগুন চাষের মাধ্যমে এরই মধ্যে খরচের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ পেয়েছেন। তাদের জমি থেকে আরো কয়েক সপ্তাহ বেগুন তুলতে পারবেন বলে তারা জানিয়েছেন। তাদের সফলতা দেখে উপজেলার অনেকেই আগাম বেগুন চাষে আগ্রহী হয়েছেন বলে জানা গেছে।
চরবাছুর আলগা গ্রামের কৃষক সোলায়মান হোসেন জানান, আগামিতে আগাম ও উন্নত জাতের বেগুনের আবাদ অকল্পনীয় হারে বাড়তে পারে। কারন হিসেবে জানান, বেগুন এমন একটি সবজি যা চাষ করলে লোকসানের সম্ভাবনা নেই। হতে পারে লাভ কম-বেশি। এই কৃষক আরো জানান, চলতি মৌসুমে তিনি ৩ একর জমিতে বেগুনের আবাদ করেছেন। এরমধ্যে চন্দ্রকোনা-চর বাছুরআলগী সড়ক সংলগ্ন ৭০ শতাংশ জমিতে গোলাকার জাতের আগাম বেগুন চাষ করেছেন। এতে জমি তৈরি, বীজ, সার ও সেচসহ অন্যান্য বাবদ প্রায় ৯০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ জমি থেকে এপর্যন্ত লক্ষাধিক টাকার বেগুন বিক্রি করেছেন। আরো অন্তত ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার বেগুন বিক্রি করতে পারবেন বলে তিনি আশা করছেন। তিনি বলেন, কীটনাশকের পরিবর্তে ফেরোমন ফাঁদ ও পার্চিং ব্যবহারের মাধ্যমে নিরাপদ বেগুন উৎপাদন করায় গত বছরের তুলনায় বালাইনাশক বাবদ খরচ অনেক কমেছে। জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনায় বেগুন চাষ করায় বেড়েছে চাহিদা, কমেছে উৎপাদন ব্যয়। ফলে দুই দিকেই লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। এছাড়া আগাম বেগুনের চাহিদা বেশি থাকায় দূরের পাইকাররা সরাসরি জমি থেকে বেগুন নিয়ে যাওয়ায় পরিবহন খরচও বেঁচে যাচ্ছে কৃষকদের।
পাইকারি বেগুন ব্যবসায়ী রেজাউল করিম, হোসেন আলী, মিন্টু মিয়া, জুব্বার আলী ও সোহেল মিয়াসহ অনেকে জানান, চাহিদা বেশি থাকায় দাম বেশি হলেও লাভও বেশি হয়। কারন হিসেবে বলেন, আমরা জমি থেকে বেশি দামে বেগুন কিনে নিয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি দামেই বিক্রি করি। ফলে আমাদের লোকসানের সম্ভাবনা নেই। তবে কোন কারনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়লে তা ভিন্ন বিষয়। নতুবা এই সবজির সাথে জড়িত কৃষক ও ব্যবসায়ীসহ সবাই কম-বেশি লাভবান হন। ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে বেগুনের পাইকারি দাম প্রতি মণ ২,১০০ টাকা থেকে ২,২০০ টাকা। পরিবহন খরচসহ প্রতি কেজি বেগুনের ক্রয় মূল্য পড়ে ৫৪ টাকা থেকে ৬০ টাকা করে। আর বিক্রি করা হয় গড়ে ৬০ টাকা থেকে ৬৫ টাকা করে। তাদের দেয়া হিসেব মতে প্রতি কেজি বেগুনে পাইকাদের লাভ হয় ৫ টাকা থেকে ৬ টাকা করে।
নকলা প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক নূর হোসেন বলেন, আমিসহ ক্লাবের কয়েকজন সাংবাদিক মিলে প্রতি বছর শাক-সবজির খবর করার লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহের জন্য এই চরাঞ্চলে আসি। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবছর চরবাছুর আলগা এলাকায় আগাম বেগুনের আবাদ অনেক বেড়েছ। এছাড়া আগের তুলনায় অনেক বেশি ফলন হয়েছে বলেও তিনি জানান।
চন্দ্রকোনা ব্লকে কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন, বাউসা ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল আলম ও বানেশ্বরদী ব্লকে কর্মরত হুমায়ূন কবিরসহ কয়েকজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বেগুনসহ সকল শাক-সবজি চাষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা নিয়মিত কাজ করছেন। এই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দিনি দিন নিরাপদ শাক-সবজির আবাদ বাড়ছে বলে তারা জানান।
ভূরদী খন্দকার পাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছায়েদুল হক জানান, নকলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের চরাঞ্চলে বরাবরই উন্নত ও আগাম জাতের বেগুনের আবাদ ভালো হয় এবং দাম বেশি পাওয়ায় কৃষকরা এই সবজি বেশি চাষ করেন।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাগর চন্দ্র দে ও কৃষিবিদ ফারিহা ইয়াসমিন জানান, নকলার মাটি বেগুনসহ শীতকালীন শাক-সবজি চাষের জন্য উপযোগী। তাই এখানের কৃষকরা শাক-সবজি চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। আর ভোক্তারা পাচ্ছেন নিরাপদ তথা বিষমুক্ত শাক-সবজি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মোরসালিন মেহেদী জানান, সঠিকভাবে সেবা করলে একটি বেগুন গাছ হতে কয়েক মাস ব্যাপী বেগুন সংগ্রহ করা সম্ভব, যা অন্যকোন ফসলে অসম্ভব। তাই যে কেউ চাইলে অল্প জমিতে বেগুনসহ শীতকালিন শাক-সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী হতে পারে।
এবিষয়ে কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা দিতে কৃষি বিভাগ সদা তৎপর বলেও জানান তিনি।