ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ইজারার শর্ত অমান্য করে মেঘনা নদীর তীর ভরাট করে বানিজ্যিকভাবে জেটি নির্মাণ করেছে উপজেলা বিএনপির সভাপতির নেতৃত্বে এক সংঘবদ্ধদল। এই জেটি থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক ভারী পণ্য নিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিটের পাশ দিয়ে যাতায়াত করছে। এতে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (এপিএসসিএল) ৬‘শ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ২টি ইউনিট বন্ধ হওয়ার আশংকাসহ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
পাশাপাশি বালি দিয়ে নদী ভরাট করায় পানি প্রবাহে গতি পরিবর্তন হয়ে নদীর দুই পারেই ভাঙ্গন সৃষ্টিরও আশংকা করা হচ্ছে। এব্যাপারে বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসক বরাবর ও বিআইডাব্লিউটিএ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আশুগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে। কিন্তু গত ১৫ দিনেও এই জেটি অপসারণ করা হয়নি। তবে উক্ত জেটি দিয়ে বর্তমানে মালামাল উঠানামা বন্ধ করা হয়েছে।
সরেজমিনে গেলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ৫ আগষ্ট রাজনৈতিক পটপরির্তনের সুযোগে উপজেলা বিএনপির সভাপতি হাজী শাহজাহান সিরাজ এর নেতৃত্বে ৩০/৪০ জনের একটি সংঘবদ্ধদল আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানীর পাশে মেঘনা নদীর তীর দখল করে বানিজ্যিকভাবে একটি জেটি নির্মানের উদ্যোগ নেয়। এক পর্যায়ে নদীর তীর বালি দিয়ে ভরাট করে জেটি নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং গত এক মাস যাবৎ এই জেটি দিয়ে বানিজ্যিকভাবে বিভিন্ন জাহাজ ও নৌকা থেকে মালামাল উঠানামা শুরু করে। বিষয়টি বিআইডাব্লিউটিএ এর স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নজড়ে আসলেও রহস্যজনক কারণে তা এড়িয়ে যায়।
গত ১৮ নভেম্বর জেলা মাসিক উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় নদী দখল করে জেটি নির্মানের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। গত ১ লা ডিসেম্বর পাওয়ার স্টেশন কোম্পানীর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ রাস্তা ও জেটি নির্মানের ফলে ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হওয়াসহ নিরাপত্তার হুমকির আশংকার বিষয়টি জেলা প্রশাসক বরবার লিখিত ভাবে জানান।
চিঠিতে উল্লেখ করেন, এপিএসসিএল দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি স্থানীয় কিছু সংখ্যক লোক মেঘনা নদীর বেশ কিছু অংশ ভরাট করে জেটি নির্মাণ করেছেন। জেটি থেকে সড়ক পর্যন্ত বালুর সড়ক রয়েছে। এই সড়কের নিচে এপিএসসিএলের ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টের কুলিং ওয়াটার পাইপ, ফায়ার এবং সার্ভিস ওয়াটার পাইপ, ড্রিংকিং ওয়াটার পাইপ এবং ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টের (সিসিপিপি) ওয়াটার আউটফল পাইপ রয়েছে। বালুর রাস্তার উপর দিয়ে ধান-চালের ভারী যানবাহন চলাচল করায় রাস্তার নিচে থাকা সকল পাইপ লাইন ক্ষতিগ্রস্তু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাইপ লাইনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই দুটি ইউনিট দীর্ঘ মেয়াদী বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে প্রায় ৬‘শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পেয়ে সারাদেশে ব্যাপক লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এই চিঠির আলোকে বিআইডাব্লিউটিএ এর আশুগঞ্জ-ভৈরব নদী বন্দর দপ্তরের উপ-পরিচালক মো: মহিউদ্দীন খান তড়িঘড়ি করে গত ৩ ডিসেম্বর জেটি দিয়ে পন্য উঠানামা বন্ধ, ক্রেন অপসারণসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আশুগঞ্জ থানায় একটি অভিযোগ দাখিল করেন এবং তিনদিনের মধ্যে এপিএসসিএলের উত্তর-পশ্চিম পাশের মেঘনার তীর নির্মিত জেটিতে নৌযান ভিড়ানোসহ মালামাল উঠানামা বন্ধ করতে উপজেলা বিএনপির সভাপতি হাজী মো. শাহজাহানকে নির্দেশ দেন।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, আশুগঞ্জ-ভৈরব নদী বন্দরের নিয়ন্ত্রণাধীন চ্যানেল-১ সোনারামপুর এলাকায় শুল্ক আদায়ে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জন্য ইজারা পান উপজেলা বিএনপির সভাপতি হাজী মো. শাহজাহান সিরাজ। গত ৩০ জুন বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের সাথে ননজুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তি করেন তিনি। চুক্তি অনুযায়ী, সকল আদেশ, নির্দেশ ও শর্তাদি মেনে চলাসহ ইজারা প্রদত্ত ঘাটের সীমানায় তীর ভূমির কোনোরূপ পরিবর্তন কিংবা নতুন কোনো পয়েন্ট তৈরি এবং ঘাট সীমানার মধ্যে স্থায়ী বা অস্থায়ী কোনো অবকাঠামো তৈরির কোনো সুযোগ নেই।
বিআইডব্লিউটিএ এর আশুগঞ্জ থানায় দায়ের করা অভিযোগে বলা হয় আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানী লিমিটেড উত্তর-পশ্চিমে মেঘনার তীর নির্মিত জেটি থেকে ভারি মালামাল ক্রেন দিয়ে নামিয়ে ট্রাকে তুলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি নির্গমনের নালার উপর দিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক পরিবহন করা হচ্ছে। যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীনসহ কর্ম পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। এপিএসসিএলের আশপাশ এলাকা অত্যন্ত স্পর্শকাতর হিসেবে চিহ্নিত। এখানে অবাধে ও অনিয়ন্ত্রিত ভারী যানবাহনের চলাচল গ্রহনযোগ্য নয়।
এব্যাপারে আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপিত মো. শাহজাহান সিরাজ বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ঘাটটি আমার নামে ইজারা দিয়েছে। জনগণের স্বার্থে জায়গাটি আমরা সংস্কার করেছি।নীতিমালার বর্হিভূত কিছু করিনি।
বিআইব্লিউটিএ এর আশুগঞ্জ-ভৈরব বাজার নদী বন্দরের উপ-পরিচালক মো. মহিউদ্দিন খান বলেন, জায়গাটি ইজারা দেয়া হয়নি। কেপিআই প্রতিষ্ঠানের পাশে এই ধরণের স্থাপনা হতে পারে না। ঘাট ও জেটি অপসারণের জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। এটি ইজারা চুক্তির শর্তাদির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জায়গাটি মালামাল উঠানো-নামানোর জন্য বিআইডব্লিউটিএ’র অনুমোদিত স্থান নয়।
এব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, বিআইব্লিউটিএ এর আশুগঞ্জ-ভৈরব বাজার নদী বন্দর কর্তৃপক্ষের এব্যাপারে কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছে জায়গাটি ইজারা দেয়া হয়নি। জেটিটি দ্রুত অপসারণের জন্য উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।