শীতের আমেজ শুরুর সাথে সাথে গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক মধুবৃক্ষ নামে খ্যাত খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন শেরপুরের নকলা উপজেলার গাছিরা। কার আগে কে কত বেশি পরিমাণ রস সংগ্রহ করবেন, এই প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তারা। কারণ শীতের সকালে খেজুর রস পানকরা ও খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েসের মজাই আলাদা। পিঠা-পায়েসের মজা মিটাতে এই রসের চাহিদা ও দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। গত বছর এক কেজি খেজুর রসের দাম ছিলো ৬৫ টাকা থেকে ৭০ টাকা, কিন্তু এবছর প্রতি কেজি রস বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা করে। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে গাছিরা রস সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। কেউ নতুন করে গাছ কাটছেন, কেউ কাটা গাছ ছাবছেন। আর শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সের লোকজন আগ্রহের সহিত গাছ কাটা ও ছাবার চিত্র দেখছেন। এমন দুই গাছি উপজেলার গৌড়দ্বার ইউনিয়নের গৌড়দ্বার গ্রামের মৃত আশকর আলীর ছেলে দুলাল মিয়া ও দুলাল মিয়ার বড় ছেলে আশিক মিয়া।
দুলাল মিয়া জানান, তিনি প্রায় দুই যুগ ধরে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন। প্রতি বছর শীতের আগমন ঘটলেই তিনি এলাকার খেজুর গাছের মালিকদের কাছে নামমাত্র মূল্যে ৩ মাসের জন্য চুক্তিতে গাছ নেন। পরে রস সংগ্রহের জন্য গাছ কাটেন। প্রতিদিন বিকেলে গাছ ছাবেন, আর ভোরে রস সংগ্রহ করে বিভিন্ন হাট-বাজারসহ এলাকা ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন। এতে প্রতিদিন ৭০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা তার আয় হয়। এ হিসেব অনুযায়ী মাসে ২১ হাজার টাকা থেকে ২৪ হাজার টাকা তার আয় হয়। আর তিন মাসে তার গড়ে আয় হয় ৫০ হাজার টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকা। এই আয় দিয়েই তার ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচসহ অন্তত ৪-৫ মাসের সংসার খরচ চলে যায় বলে তিনি জানান।
দুলাল মিয়া জানান, তার নিজস্ব কোন জমি ও ঘর নেই। এই স্মার্ট যুগে এসেও গৌড়দ্বার এলাকায় অন্যের জায়গায় অধাভাঙ্গা ছোট একটি ঘর করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। জীবনের শেষ মুহূর্তে হলেও যেন নিজের ঘরে ঘুমিয়ে মৃত্যু বরণ করতে পারেন এর জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের সুদৃষ্টি কামনা করেন দুলাল।
ষাটোর্ধ্ব দুলাল মিয়া কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেন, ‘আগে শইল্যে শক্তি সাহস আছিলো, তহন সারাবছর পাড়া ঘুইরা নারিকেল, সুপারি, তাল ও খেজুর গাছ ছাবতাম। তাতে সংসার ভালোই চলতো। কিন্তু কয়েক বছর ধইরা দুই ঠ্যাঙ্গের রগে কি জানি অইছে, বেশি আটবারই পাইনা, গাছ কটমু কিবে, ছাবমু কিবে? ঠ্যাং নিয়া অহন পাড়া ঘুইরা নারিকেল, সুপারি, তাল ও খেজুর গাছ ছাববার পাইনা। তাছাড়া আগের মতো নতুন খেজুর গাছও নাই। উচা উচা গাছে উইট্টা গাছ কাডা অহন সাহসে ধরেনা। তাও প্রতি শীতে কষ্ট কইরা ৪-৫ টা গাছ কাডি। পরে পোলাপনরা প্রতিদিন বিকালে ওইসব গাছ ছাবে ও রস নামায়। অহন যে কয়ডা গাছ কাটি ওই রস বেইচ্চা সংসার চলেনা। তাই অনেক সময় সংসারের সবাইরে না খাইয়া থাহুন নাগে।’
অন্যএক গাছি আশিক মিয়া জানান, খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে হলে প্রথমে খেজুর গাছের উপরের অংশ ভালো করে পরিষ্কার করে কেটে সাদা অংশ বেড় করে রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। পরে প্রতিদিন বিকেলে কাটা অংশ ছেবে সেখানের নিচের অংশে নলি লাগিয়ে বিশেষ কায়দায় ছোট-বড় বাসন বেঁধে রস সংগ্রহ করা হয়। এ রস হাট-বাজারে, পাড়া-মহল্লায় খাওয়ার জন্য বিক্রি করা হয়। এছাড়া কেউ কেউ খেজুরের জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করে উচ্চ দামে বিক্রি করেন। রসের চেয়ে গুড়ের দাম বেশি পাওয়া যায়. তাই গুড়ের চাহিদাও বেশি থাকে। দাম ও চাহিদা বেশি থাকার কারন হিসেবে গাছিরা জানান, শীতকালীন খাদ্য তালিকায় প্রথমেই যার নাম চলে আসে, তাহলো মুখরোচক খেজুরের রস। শীত বাড়ার সাথে সাথে খেজুর রসের চাহিদা ও দামও বাড়তে থাকে বলে তারা জানান। তবে কালের বিবর্তনে খেজুর গাছ কমে যাচ্ছে। ফলে অনেক এলাকাতেই আগের মতো খেজুর গাছ দেখা যায়না। কেউ কেউ জানান, বিভিন্ন কারনে দিন দিন খেজুর গাছ হারিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় মেহেদী হাসান শাহাদত বলেন, গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুর রস সংগ্রহে শীতকালে প্রতিটি গ্রামে গাছিরা খেজুরগাছ কাটার কাজে ব্যস্ত সময় পার করতেন। আগে আমাদের গ্রামে ১৫ থেকে ২০ জন গাছি গাছ কাটতেন। এখন তা কমে ৩ থেকে ৪ জনে নেমে এসেছে। আগে এক হাড়ি রসের দাম ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা, এখন এক হাড়ি রসের দাম ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমার অবাক লাগে আগের তুলনায় খেজুর রসের দাম কয়েকগুণ বাড়লেও, বাজারে কথিত খেজুর রসের তৈরি গুড়ের দাম সেই তুলনায় বাড়েনি। এতেই সুস্পষ্ট যে, বাজারে যেসব গুড়কে খেজুরের গুড় হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা শতভাগ খেজুরের রসে তৈরি নয়।
কলাপাড়া এলাকার নূর হোসেন বলেন, আমাদের এলাকায় খেজুর গাছ কেটে রস বের করার কোনো গাছি পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকের বাড়িতে গ্রাম বাঙলার মধুবৃক্ষ নামে খ্যাত খেজুর গাছ থাকলেও গাছির অভাবে তা কেটে রস বের করা যাচ্ছে না। কোন প্রকার লেনদেন বা টাকা পয়সার শর্ত ছাড়াই শুধুমাত্র কিছু রসের বিনিময়ে হলেও গাছ কাটার গাছি পেলে ভালো হতো। কিন্তু গাছি না পাওয়ায় আমরা গাছ থেকে রস বের করতে পারছিনা। তাই বাধ্য হয়ে বাজার থেকে কথিত খেজুর রসের গুড় বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।
গাছিরা বলেন, আগে এলাকায় কর্মক্ষেত্র কম থাকায় গাছি বেশি ছিলো। এখন কর্মক্ষেত্র বৃদ্ধি পাওয়ায় সবাই ব্যস্ত সময় পার করেন। তাই আগের মতো গাছি পাওয়া যায়না। ফলে কয়েকজন গাছির পক্ষে সব খেজুর গাছ কাটা সম্ভব হয়না। তাছাড়া খেজুর গাছে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে গাছিরা কোমরে রশি বেঁধে গাছে ঝুলে গাছ কাটা, ছাবা ও রস সংগ্রহের কাজ করেন। সেই তুলনায় তাদের আয় হয়না। তাই অনেকেই আগ্রহ হারিয়েছেন। তবে দাম ও চাহিদা বাড়ায় আগামীতে গাছির সংখ্যা বাড়তে পারে বলে মনে করছেন গৌড়দ্বার এলাকার গাছি দুলাল মিয়া ও আশিক মিয়া।
অন্যান্য ফসল বা ফলের তুলনায় খেজুর গাছে লাভ নেই বললেই চলে। তাছাড়া খেজুর গাছ কাটা, রস সংগ্রহ ও বিক্রি করায় যে সময় ব্যয় হয়, সেতুলনায় আয় কম হয়। তাই এই গাছের প্রতি কৃষক ও গাছির আগ্রহ দিন দিন কমে শূন্যেরকোঠায় নেমে গেছে। বছরের পর বছর খেজুরগাছ রোপন না করায় এই সুপরিচিত গাছ ও গাছির পেশাটি বিলুপ্তির পথে। আর গাছ ও গাছি না থাকায় বিলুপ্তির পথে খেজুর রস। তাই ভোজনপ্রিয় লোকজন বাধ্য হয়ে বাজার থেকে কথিত খেজুরের রসের নামে ভেজাল খেজুরের রস ও খেজুরের গুড় কিনে প্রতারিত হচ্ছেন, বলে অনেকে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, প্রতিটি সড়কের পাশে ও খালি জায়গায় খেজুরগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো উচিত। তাতে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারাসাম্য রক্ষা হবে, অন্যদিকে রাস্তার ভাঙ্গন রোধ হবে এবং নিরাপদ খেজুরের রস ও খেজুরের গুড় পাওয়া যাবে।