রেললাইনের দুপার্শ্বে সারি সারি খেজুর গাছ। সে গাছগুলোতে এখন ঝুলছে গাছিদের টানানো মাটির হাড়ি। সন্ধ্যায় বেঁধে আসা সেই হাড়িতে রাতভর সংগ্রহ হচ্ছে খেজুর রস। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে সে রসভর্তি হাড়িগুলো থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরির কাজে লেগে পড়ছেন গাছিরা।
রোজ ভোরে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে চোখে পড়ছে এমনি অপরূপ দৃশ্য। এ যেনো হারিয়ে যাওয়া চিরচেনা গ্রামবাংলার প্রতিচ্ছবি।
ফুলবাড়ী-বিরামপুর রেলপথের মাঝামাঝি এলাকার বারোকোনা গ্রামের শেষ সীমানায় সাহাবাজপুর নয়াপাড়ায় নামক স্থানে রাজশাহী থেকে এসেছেন কিছুসংখ্যক গাছিয়া। যারা ওই রেলপথে সারি সারি থাকা প্রায় দেড় শতাধিক খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তৈরি করছেন খেজুর গুড়।
সরেজমিনে সাহাবাজপুর নয়াপাড়া রেল লাইনের পার্শ্বে গিয়ে দেখা যায়, রেললাইনের দুপাশে সারি সারি রয়েছে খেজুরের গাছ। সেসব গাছে আগের দিন সন্ধ্যায় টানিয়ে আসা হয়েছে মাটির হাড়ি। রাতভর রস সংগ্রহের পর কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে প্রতিটি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন গাছিরা। সূর্য উঠার পরপরই নির্ধারিত একটি স্থানে মাটির তৈরি চুলায় টিনের কড়াই বসিয়ে সংগৃহিত রস ঢেলে আগুনে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে সুস্বাদু খেজুরের গুড়-পাটালি ও লালি। নতুন খেজুর রসের গুড় তৈরির পর তা চলে যাচ্ছে স্থানীয় হাট-বাজারে। কেউ কেউ তৈরির স্থান থেকেই টাটকা গুড় কিনে পরিবারপরিজনসহ আত্মীয়-স্বজনের কাছে পাঠাচ্ছেন।
জানা যায়, গাছিয়া আশরাফ উদ্দিন (৫৮) ও সুমন সরকার (৩৮) রাজশাহী বাঘা উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের বাসিন্দা। শীত মৌসুমে খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করে সেগুলো জ্বাল দিয়ে খেজুরের গুড়-পাটালি ও লালি তৈরি করে বিক্রি করেই চলে ছয় মাসের ভরণ-পোষণ। গত বছর একই গ্রামের কয়েকজন গাছিয়া ফুলবাড়ীতে এসে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির কারবার করেন। কিন্ত তারা এ বছর আসবেন না এমন তথ্য পেয়ে আশরাফ উদ্দিন ও সুমন সরকার এ বছর চলে এসেছেন এখানে। রেললাইনের পশ্চিম পার্শ্বে ঝুপড়ি তৈরি করে সেখান থেকে চলছে তাদের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির কারবার। এ বছর ফুলবাড়ী ও বিরামপুর সীমান্ত এলাকার রেল লাইনের দুই পার্শ্বের দেড় শতাধিক খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ গুড়-পাটালি ও লালি তৈরি করছেন। প্রতিদিন গড়ে ১৪ থেকে ১৫ কেজি গুড়-পাটালি ও লালি তৈরি করছেন। যেগুলো স্থানীয় গ্রামবাসীরাই ২২০ টাকা কেজি দরে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে বাজারে বিক্রির কোনো গুড় থাকছে না। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন তাদের গড়ে আয় হয় ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। বছরে পাঁচ মাস তারা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি ও বিক্রির কাজ করলেও অন্য সময়ে নিজ এলাকায় থেকে অন্য পেশায় নিয়োজিত থাকেন।
গাছিয়া আশরাফ উদ্দিন ও সুমন সরকার বলেন, পৈত্রিক সূত্রে এই পেশায় আসা। দেশের বিভিন্ন স্থানের খেজুর গাছ চুক্তিতে নিয়ে সেই সব গাছের রস নামিয়ে গুড় তৈরি ও বিক্রি করে থাকেন। ওই এলাকার রেললাইনের পাশের দেড় শতাধিক খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে সেগুলোর গুড় তৈরি করে স্থানীয়ভাবে আশপাশের গ্রামবাসীদের কাছে বিক্রি করছেন। প্রস্তুত করা প্রতিটি গাছ থেকে প্রতিদিন রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি গাছ থেকে শুরুতে এক থেকে দুই কেজি করে রস সংগ্রহ হয় এবং আস্তে আস্তে এর পরিমাণ বাড়তে থাকে। এটাই তাদের মূল পেশা।
গুড় কিনতে আসা বারোকোনা গ্রামের হাপিজা বেগম ও ফয়েজার হোসেন বলেন, শীত শুরুর পর থেকেই পিঠা-পায়েস খেতে খেজুর গুড়ের প্রয়োজন হয়। এখানে গাছিদের তৈরি গুড় নির্ভেজাল ও মানসম্মত। এ জন্য আশপাশের গ্রামের লোকজনই গুড় তৈরির পরপরই সবগুড়ই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।