কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায় প্রায় চার’শ বছরের পুরনো সেকান্দরনগর জামে মসজিদটি মুঘল আমলের স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। মসজিদটির মূল অবয়ব আজও অক্ষত অবস্থায় থাকলেও প্রত্নতত্ব বিভাগের সঠিক পরিচর্যার অভাবে বর্তমানে স্থপনাটি বিলীন হওয়ার পথে। নান্দনিক স্থাপত্য কলায় নির্মিত সেকান্দরনগর জামে মসজিদটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রতিনিয়ত বিমোহিত করছে।
সূত্র জানায়, সেকান্দরনগর সাহেব বাড়ি জামে মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নেয়ার জন্য ইতোমধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা মসজিদটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে ছবি, মৌজা ও ম্যাপসহ প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। পরবর্তী সময়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক প্রতিবেদনটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু অদ্যাবধি মসজিদটি সংস্কার ও রক্ষাণাবেক্ষণের ব্যাপারে আদৌ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ১৯৮২ সালের ১২ আগষ্ট কিশোরগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ.এম.এস ফরহাদ ৬০৭ নম্বর স্মারকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তখনকার সচিব ড. এস. জামান মজুমদার বরাবরে একটি ডি.ও লেটারের মাধ্যমে (ডি.ও.নম্বর জে: প্র: কি: ৬৭-৬০৭) জেলার তাড়াইল উপজেলার সেকান্দরনগর সাহেব বাড়ি জামে মসজিদটি মূল্যবান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে অনুরোধ করেন। যার অনুলিপি মহাপরিচালক প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছিল।
স্থাপত্যকলার অনুপম নির্দশন ঐতিহাসিক সেকান্দরগর মসজিদটি তাড়াইল উপজেলার ৩ নং ধলা ইউনিয়নের সেকান্দরনগর গ্রামে অবস্থিত। কালের আর্বতে এই মসজিদের নাম শাহ সেকান্দরনগর জামে মসজিদ হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। সতের শ’ ৯৬ খ্রিষ্টাব্দের পর সেকান্দরনগরে আগমন ঘটে এই অঞ্চলের বিখ্যাত ইসলাম প্রচারক হযরত সৈয়দ শাহ জামান রহ. এর। তাঁরই সমসাময়িক এবং আত্মীয় হযরত শাহ সেকান্দর রহ.। তৎকালীন এ দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ৩৬০ জন আউলিয়া’র আগমন ঘটে। তাদেরই একজন শাহ্ সেকান্দর রহ.। শাহ সেকান্দর রহ. এই স্থানে এসে বসতি স্থাপন করেন এবং পরবর্তীতে এই গ্রামটি তার নিজ নামেই নামকরণ হয় সেকান্দরনগর। হযরত শাহ্ সেকান্দর রহ. এর অবস্থানকে কেন্দ্র করেই এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। মসজিদের পাশেই রয়েছে শাহ্ সেকান্দর রহ. মাজার।
সরেজমিন দেখা যায়, বাহির থেকে মসজিদটি বিশাল আকার দেখা গেলেও ভেতরের অংশ ছোট। মসজিদটিতে মোট আটটি মিনার রয়েছে। মিনারগুলো ছাদের উপরে ওঠে গেছে। মসজিদের উত্তর-দক্ষিণের দেয়ালে রয়েছে একটি করে প্রবেশ পথ। সম্মুখ দেয়ালের মাঝে প্রবেশ পথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে একটি মাত্র মেহরাব। মসজিদের ভেতরে ইমাম বাদে তিনটি কাতারে ১২ জন করে মোট ৩৬ জন মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে মসজিদের বাহিরের অংশে অর্থাৎ বারান্দায় আরো প্রায় অর্ধশত মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। আয়তাকারে নির্মিত এই মসজিদের দৈর্ঘ্য ৪৪ ফুট এবং প্রস্থ ২৫ ফুট। সম্মুখ দেওয়ালে রয়েছে পত্রখিলান সমৃদ্ধ তিনটি প্রবেশ পথ। মাঝের প্রবেশ পথটি কিছুটা বড়। এই মসজিদের সম্মুখের সাহনের পরিমাণ ৫৪ ফুট বাই ৩৬ ফুট। মসজিদের আকার বা পরিধি যাই হোক না কেন আপনি মসজিদে প্রবেশ করে নামাজ আদায়ের সময় নিজেকে মনে হবে দু’শ বছর আগের মুঘল আমলেই বুঝি চলে গেছেন। এক অদ্ভুত অনুভূতি হবে। উপস্থিত হয়ে নামাজ না পড়লে বিশ্বাস করানো বা বোঝানো সম্ভব নয়।
মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা আবু সায়েম বলেন, সেকান্দরনগর মৌজার ১ নং খতিয়ানভূক্ত ৫৬৫ সাবেক দাগে ১০ শতাংশ ভূমির উপর কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে মুঘল আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক সাহেব বাড়ি জামে মসজিদটি। মসজিদের পবিত্রতা রক্ষার্থে সীমানা প্রাচীর করা খুবই প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, মসজিদ সংলগ্ন গভীর পুকুরটির পাড় যেভাবে ভেঙে আসছে তাতে মসজিদটি হুমকির মুখে রয়েছে। পুকুর ঘেঁষে একটি প্রতিরক্ষা দেয়াল দেওয়া অতীব জরুরি।
প্রায় চার’শ বছরের পুরনো মুঘল আমলের সেকান্দর নগর জামে মসজিদটি রক্ষায় প্রশাসনের আন্তরিক হওয়া অতীব প্রয়োজন বলে মনে করেন তাড়াইল উপজেলার সচেতন মহল।
তারা বলেন, স্থাপত্য কলায় নির্মিত এ মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এলাকাবাসী সহ সকলকেই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।