স্বল্প খরচে লাভ বেশি পাওয়ায় পান চাষে ঝুঁকছে কৃষক
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:১৪ | অনলাইন সংস্করণ
মো. মোশারফ হোসাইন, নকলা (শেরপুর) প্রতিনিধি
অল্প জমিতে কম খরচে অধিক লাভবান হওয়ার কারণে শেরপুরের নকলা উপজেলায় পান চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ধান, গম, ভুট্টা কিংবা আলুর তুলনায় পান চাষ অধিক লাভজনক হওয়ায় স্থানীয় কৃষকরা দিন দিন এ ফসলের দিকে ঝুঁকছেন।
উপজেলার গণপদ্দী, নকলা, বানেশ্বরদী, পাঠাকাটা ও টালকী ইউনিয়নসহ পৌর এলাকার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকরা পান চাষে সফলতা অর্জন করেছেন। এরমধ্যে বানেশ্বরদী ও পৌর এলাকার বেশ কয়েকজন পানচাষী কয়েক বছর ধরে সব আবাদ বাদ দিয়ে শুধুই পান চাষ করছেন। বিঘাপ্রতি পানের বরজে কম-বেশি ১ লাখ টাকা খরচ করে পরবর্তী বছর থেকে চাষীরা বছরে লাভ করছেন আড়াই লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা। যা অন্যকোনো আবাদে সম্ভব নয়।
বানেশ্বরদী ইউনিয়নের বানেশ্বরদী উত্তর পাড়া এলাকার পান চাষি আজাহার আলী বলেন, “আমরা তিন ভাই ১৯৮৩ সাল থেকে পান চাষ করছি। অল্প জমিতে কম খরচে এই চাষ থেকে যে পরিমাণ লাভ পাওয়া যায়, তা অন্য কোনো ফসলের ক্ষেত্রে কল্পনাও করা যায় না।” আজাহার আলীর ১০ শতাংশ জমিতে ৮ আনা পানের বরজ রয়েছে, যা থেকে বছরে ৪-৫ লাখ টাকা আয় সম্ভব। আমার দুই ভাই আক্কেল আলী ও আনসার আলীও পান চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। তাই আমাদের দেখাদেখি এলাকার অনেকেই পানের বরজে ঝুঁকছেন। কেউ কেউ নতুন বরজ করে সফলতার মুখ দেখছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
বানেশ্বরদী গ্রামের আব্দুর রহিম ২২.৫ শতাংশ জমিতে ১৮ আনা পানের বরজ করেছেন। তিনি জানান, “এ বরজ থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে সংসারের খরচ চালানোর পরও বছরে কয়েক লাখ টাকা সঞ্চয় করা সম্ভব।”
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বানেশ্বরদী ইউনিয়নের আজাহার আলী, আক্কেল আলী, আনসার আলী, আব্দুর রহিম ছাড়াও মৃত আলীম উদ্দিনের ছেলে আমির উদ্দীন ১৪ আনা পানের বরজ করেছেন। মৃত মমতাজ আলীর ছেলে আব্দুস সাত্তার ৬ আনা ও আব্দুস সাত্তারের ছেলে রবিন মিয়া করেছেন ৮ আনা পানের বরজ।
পান চাষি আমির উদ্দীন বলেন, পানের বরজে অন্যান্য ফসলের তুলনায় পরিশ্রম বেশি লাগলেও অল্প জমিতে কম খরচে বেশি লাভ পাওয়া যায়। কয়েক বছর ধরে সারাবছর পানের দাম ভালো থাকায় আমরা পান বরজের মালিকরা সবাই অন্যদের তুলনায় পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো আছি। তবে কৃষি অফিস থেকে পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় অনুসাঙ্গিক সহযোগিতা পেলে উপজেলার অনেক ক্ষুদ্র কৃষক অল্প জমিতে পানের বরজ করে স্বাবলম্বী হতে পারবে।
পান চাষীদের দেওয়া তথ্য মতে, পানের বরজ গড়তে নতুন অবস্থায় বাঁশের ৪টি শলাতে ১ গাছ হিসেব করা হয়। ৬ মাস পরে প্রতিটি গাছের বা ৪ শলার ভিতরে আরো ৪টি শলা দেওয়া হয়। তাতে ৬ মাস পরে ৮ শলাতে ১ গাছ ধরা হয়। এমন ১০০টি গাছে বা ৮০০টি শলাতে ১ আনা হয়। তাদের দেওয়া হিসেবে মতে, ৮ আনার বরজে প্রথম ৬ মাসে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ব্যয় হয়। উল্লেখযোগ্য ব্যয়ের মধ্যে, পানের পর বা লতি ক্রয় বাবদ ৩০ হাজার টাকা, খুঁটি বা শলা দিতে বাঁশ বাবদ অন্তত ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা, ভেড়া ও ছাউনি দিতে ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা, জৈব সার হিসেবে গোবর ও সামান্য কিছু রাসায়নিক সার বাবদ আরো অন্তত ৫ হাজার টাকা লাগে। এছাড়া ৮ আনা বরজে বছরে অন্তত ২২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার মাটি লাগে। পানের নতুন পর বা লতি রোপণের পরে ৫-৬ মাসের মধ্যে পান পাতা বিক্রি করার উপযোগী হয়। তবে পান পাতা তুলা পর্যন্ত ৮ আনার বরজে শ্রমিক মজুরিসহ সব মিলিয়ে অন্তত ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয় চাষীদের।
নকলার শ্রমিক সংকটের কথাও উল্লেখ বরজ মালিক আনসার আলী জানান, নকলাতে আগে পান বরজের শ্রমিক পাওয়া যেতো, তবে এখন নকলাতে বরজ শ্রমিক নেই। তাই শেরপুর সদর উপজেলার সূর্যদী এলাকা থেকে শ্রমিক আনতে হয়। প্রতি শ্রমিকের খাওয়া বাদেই মৌসুম ভেদে মজুরি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। সাধারণত কার্তিক মাসে নতুন করে বরজে পানের পর বা লতি রোপণ করতে হয়। আর চৈত্র-বৈশাখ মাস থেকে অল্প অল্প করে পান পাতা তুলা শুরু করা হয়। বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত পানের ভরা মৌসুম; তাই এসময় দাম কিছু কম থাকে। তবে ভাদ্র থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত পানের উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বরাবরই বেশি থাকে।
বানেশ্বরদী গ্রামের পানের পাইকারি আব্দুছ সাত্তার জানান, ৮০টি পানে এক ভীরা হিসেব করা হয়। পানের আকার ভেদে প্রতি ভীরা (৮০ পান) পানের বর্তমান পাইকারি দান ৩০ টাকা থেকে ২২০ টাকা। আর প্রতি ভীরা পানের খুচরা দাম ৪০ টাকা থেকে ২৮০ টাকা। তিনি বলেন, আমরা বরজ মালিকের বাড়ি থেকে বা সরাসরি বরজ থেকে পান কিনে নিয়ে বিভিন্ন বাজারে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করি। আমরা বিভিন্ন বাজারের ছোট ও মাঝারি পাইকারদের কাছে অল্প লাভে পাইকারি বিক্রি করি। খুচরা প্রতি ভীরাতে ১০ থেকে ২০ টাকা লাভে এবং পাইকারি প্রতি ভীরাতে ৫ থেকে ১০ টাকা লাভে বিক্রি করে থাকি। তিনি জানান, তার মতো বানেশ্বরদীর জুব্বার আলী, হোসেন আলী ও শহীদ মিয়া, ভূরদী এলাকার শফিক, শরাফত, আকাব্বর আলী ও মণ্ডলসহ অনেকেই খুচরা ও পাইকারি পানের ব্যবসা করেন।
ভৌগোলিক অবস্থান ও পান বরজের উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলের চাষিরা অর্থকরী ফসল হিসেবে পান চাষ করে আসছেন। অন্য ফসল চাষাবাদের পাশাপাশি উপজেলার অর্ধশতাধিক কৃষি পরিবার পান চাষের সাথে জড়িত আছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদি জানান, “পান চাষ বাড়াতে এবং কৃষকদের সহায়তা দিতে আমরা নিয়মিত কাজ করছি। নিরাপদ ও জৈব পদ্ধতিতে পান উৎপাদনের জন্য কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পান চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি এবং বেকারত্ব হ্রাসের সুযোগ রয়েছে।”