খুন, চুরি, ডাকাতিসহ অপরাধ নির্মূলে কক্সবাজার শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে জেলা পুলিশ, পৌরসভা ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে বসানো অধিকাংশ সিসি ক্যামেরা এখন অকেজো। যার কারণে খুনসহ নানা অপরাধে জড়িত অপরাধীদের শনাক্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পুলিশের তথ্য বলছে, গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দুর্বৃত্তের গুলিতে খুলনা সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপু খুন হন। এছাড়া গত চার মাসে কক্সবাজারে খুন হয়েছে ৫৬ জন।
সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট থাকায় নিয়মিত অপরাধ শুধু নয়, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার উপর গুলিবর্ষণকারীদেরও এখনো শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
অন্যদিকে কক্সবাজার পৌরসভার সড়ক বাতিগুলোও অচল হয়ে পড়েছে। যার কারণে সন্ধ্যা হলে কক্সবাজার শহরের অলিগলিতে ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। চুরি ও ছিনতাই এখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জেলা পুলিশের বসানো ৬৫টি ক্যামেরার মধ্যে ৪৯টি অচল রয়েছে। এছাড়া পুলিশের আরেক তথ্য বলছে, কক্সবাজার পৌরসভার ২৫টি সিসি ক্যামেরা ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বসানো শতাধিক সিসি ক্যামেরা অকেজো অবস্থায় রয়েছে।
অনুসন্ধান বলছে, জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলি, হত্যার মিশন বাস্তবায়নে আওয়ামী সন্ত্রাসী চক্র কক্সবাজারে পুলিশ-সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুই শতাধিক সিসি ক্যামেরা নষ্ট করে দেয়া হয়।
জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের দিকে কক্সবাজার পৌরসভার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অলিগলিসহ সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউপির লিংকরোড পর্যন্ত দেড় শতাধিক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে ওই সময়ে কক্সবাজার পৌরসভার প্রধান সড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ৪০টি পয়েন্টে ৬৫টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়।
সিসি ক্যামেরার আওতায় আসা স্থানগুলো হলো- বাসটার্মিনাল পুলিশ বক্স ও সিএনজি পাম্প, কক্সবাজার কারাগার, স্টেডিয়ামের সামনে ও মোহাজের পাড়ার মোড়, সদর হাসপাতালের দক্ষিণ ও পূর্ব পাশের মোড়, জেলা শিক্ষা অফিসের সামনে ( সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়), গোলদিঘীর পাড়ের দক্ষিণ মোড়, অগগমেধা ক্যাং (বৌদ্ধ মন্দির ) সড়ক, বার্মিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের উত্তর মোড়, বড় বাজার সামনে মোড় ( বাজারঘাটা) ,ভোলাবাবুর পেট্রোল পাম্প, লালদিঘীর পূর্ব পাড় মসজিদের সামনে, পৌরসভার সামনে, গুমগাছ তলা (শ্যামলী কাউন্টারের পাশে) , বিমানবন্দর গেইটের সামনে, ঝাউতলা হোটেল রেনেসার সামনের যাত্রী ছাউনিতে, হলিডের মোড়ের যাত্রী ছাউনির সামনে ও পিটিআই স্কুলের সামনের মোড়ে (পিডিবির সামনে)।
এছাড়াও আরআরআরসি অফিসের সামনে (বাণিজ্য মেলার মাঠ), লাবণীর মোড়ের যাত্রী ছাউনি, কল্লোল মোড়, হান্ডি রেস্টুরেন্টের মোড়, সী ইন পয়েন্ট ট্যুরিস্ট পুলিশ বক্স, সুগন্ধার মোড় ( ড্রাগন মার্কেটের সামনে), কলাতলীর পেছনের মোড় (সী ক্রাউন এর সামনে), কলাতলীর মোড়, হোটেল সী প্যালেসের উত্তর ও দক্ষিণ পাশ, সুগন্ধা পয়েন্ট ট্রাফিক পুলিশ বক্স, লং বীচের পাশে ( মোহাম্মদীয়া হোটেল সামনের পশ্চিম পাশ), নিরিবিলি অর্কিড এর এটিএম বুথের পাশে, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনে (কটেজ জোনের পাশে) জাম্বুর মোড়, গোলচত্বর মোড়ের দক্ষিণ পাশে ( ইউএনএইচসিআরের পেছনের রাস্তা), পাসপোর্ট অফিসের সামনে, সার্কিট হাউস গেইট, পুলিশ সুপার বাসভবনের সামনের মোড় ও পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়।
সূত্র মতে, কক্সবাজার এখন ইয়াবা পাচারকারী চক্রগুলোর ‘নিরাপদ স্বর্গ’ হয়ে উঠেছে। অপরাধের তালিকা থেকে বাদ যায়নি মানবপাচারের মতো ঘটনা। এমন অনেক ঘটনায় ২০২৪ সালজুড়ে আলোচনায় ছিল কক্সবাজার। গেল চারমাসে জেলায় ৫৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ডাকাত দলের হাতে সেনা কর্মকর্তা খুন আর মাকে হত্যার পর থানায় ছেলে হাজির হওয়ার মতো ঘটনা। এসব হত্যাকাণ্ড ছাড়াও জেলায় অপহরণ বাণিজ্য, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ বেড়েছে কয়েকগুণ। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিশেষ জেলা হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরও বেশি তৎপরতা বাড়ানো দরকার। প্রয়োজনে কৌশল পরিবর্তন করাও জরুরি। পুলিশ জানিয়েছে, নানামুখী তৎপরতার পাশাপাশি সামাজিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
পুলিশের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪ সালে জেলায় ১৭৯ জন হত্যার শিকার হন। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৭৬টি। শেষ চারমাসেই খুন হয়েছেন ৫৫ জন। পুরো বছরে সবচেয়ে বেশি ২২টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে জুন মাসে। আরেক প্রতিবেদনে পুলিশ জানিয়েছে, ২০২৪ সালে অপহরণের মামলা হয়েছে ৪০টি। অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৯২ জন।
তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি রাতে কক্সবাজার শহরের বাসটার্মিনাল এলাকায় ব্যাডমিন্টন খেলাকে কেন্দ্র করে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। এরপর ২৩ নভেম্বর রাত আড়াইটার দিকে কক্সবাজার শহরে মাদক সেবনের টাকা চেয়ে না পাওয়ায় মাকে কুপিয়ে হত্যার পর থানায় হাজির হয়ে পুলিশের কাছে ধরা দেয় এক যুবক।
কক্সবাজার পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ঝিলংজা পশ্চিম বড়ুয়া পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। সদর থানার ওসি ইলিয়াস খান তখন সাংবাদিকদের এ তথ্য দেন। নিহত আনোয়ারা বেগম (৫৫) একই এলাকার নিয়াজ আহমেদের স্ত্রী। গ্রেপ্তার হোসাইন মোহাম্মদ আবিদ (২৮) নিহতের ছেলে।
২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে চকরিয়ায় পূর্ব মাইজপাড়া এলাকায় ডাকাতির খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার নির্জন (২৩)। এরপর তিনি অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তদের তাড়া করতে থাকেন। একপর্যায়ে ডাকাত দলের সদস্যদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন মেধাবী এই তরুণ সেনা কর্মকর্তা। যা দেশজুড়ে আলোচিত হয়।
এক ডিসেম্বর রামুর কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের বালুবাসা গ্রামে সাহাব উদ্দিন (২৩) নামের এক তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি একই ইউনিয়নের কচ্ছপিয়া তিতারপাড়া গ্রামের এমদাদ মিয়ার ছেলে। পুলিশ জানিয়েছে, আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে বাগবিতণ্ডার জেরে প্রতিপক্ষের লোকজন সাহাব উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন। তবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের দাবি, স্থানীয় তিন ব্যক্তিকে জিম্মি করে তাদের কাছে থাকা নগদ টাকা লুটের সময় গণপিটুনিতে সাহাব উদ্দিনের মৃত্যু হয়েছে।
২৬ আগস্ট রাত ১০টায় পেকুয়া বাজারের পশ্চিমে ওয়াপদা অফিসের সামনে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে শ্রমিক দল নেতা শহিদুল ইসলাম শওকতকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তার দুই ভাই গুরুতর আহত হন। ২১ অক্টোবর ভোরে কক্সবাজারের উখিয়ার ময়নারঘোনা আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১৭) রোহিঙ্গা পরিবারের ঘরে ঢুকে গুলি করে বাবা-ছেলে-মেয়েসহ তিনজনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। নিহতরা হলেন- আহমেদ হোসেন (৬০), তার ছেলে সৈয়দুল আমিন (২৮) ও মেয়ে আসমা বেগম (১৩)।
যোগাযোগ করা হলে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (অথরাইজ অফিসার) মোহাম্মদ রিশাদ উন নবী বলেন, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বসানো সিসি ক্যামেরাগুলো জেলা পুলিশ তদারক করেন। পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো সিসি ক্যামেরা নষ্টের অভিযোগ আসলে তা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সচল করার ব্যবস্থা করা হয়। তবে এই কর্মকর্তা বর্তমানে কত সিসি ক্যামেরা অচল রয়েছে তা বলতে পারেননি। এর জন্য জেলা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী পুলিশের বসানোর মধ্যে ৪৯ টি সিসি ক্যামেরা অকেজো থাকার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, শুধু পুলিশের সিসি ক্যামেরা নয়, পৌরসভা ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বসানো সিসি ক্যামেরাও অচল রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, জেলা পুলিশের ক্ষতিগ্রস্ত ক্যামেরা মেরামত করার জন্য সম্ভাব্য ব্যয়ের চাহিদাপত্র তৈরি করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। বরাদ্দ কিংবা সহযোগিতা পেলে ক্যামেরা গুলো সচল করা হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, অপরাধ নির্মূল পুলিশের নিয়মিত কাজ।
জেলাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ তৎপর রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্প্রতি কিছুসংখ্যক বিচ্ছিন্ন ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। এইসব ঘটনা নিয়েও পুলিশের পৃথক টিম কাজ করছে।