শেরপুরের নকলা উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলের অনুর্বর জমিতে তুলা চাষে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কৃষকরা তুলার ব্যাপক ফলন পেয়েছেন, যার ফলে চাষিরা আশা করছেন, খরচের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ পাবেন।
কয়েক বছর ধরে জলবায়ু সহনশীল কার্পাস তুলা চাষে খরচ কম এবং লাভ বেশি হওয়ায় স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে তুলা চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। একদিকে যেমন তুলা চাষের মাধ্যমে কৃষকরা নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করছেন, অন্যদিকে এটি ‘সাদা সোনা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
নকলায় কার্পাস তুলা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের বাছুর আলগা, চন্দ্রকোনা, চক বড়ইগাছি, কাজাইকাটা ও গোয়ালের কান্দা এবং চরঅষ্টধর ইউনিয়নের নারায়ণ খোলা এলাকার অনেক কৃষক। অনুর্বর জমিতে কম পুঁজিতে নাম মাত্র শ্রমে ও সরকারি সহযোগিতা পাওয়ায় উপজেলায় তুলা চাষের পরিমাণ ও চাষির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাদের উৎপাদিত তুলা সরাসরি তুলা উন্নয়ন বোর্ড ন্যায্য দামে কিনে নেওয়ায় বিক্রির জন্য বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয়না। ফলে কৃষকরা অন্য ফসলের তুলনায় সাদা সোনা খ্যাত তুলাতে আগ্রহী হচ্ছেন, হচ্ছেন অধিক লাভবান।
নকলা সাব কটন ইউনিট অফিস সূত্রে জানা গেছে, নকলায় গত বছরের তুলনায় এবছর দ্বিগুণের চেয়েও বেশি জমিতে তুলা চাষ করা হয়েছে। গত বছর নকলা ইউনিটে ৪০ হেক্টর জমিতে তুলার আবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু এবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ হেক্টরে। এবছর ৯০ হেক্টর জমিতে ১৪৬ জন কৃষক তুলা চাষ করেছেন। এছাড়া সরকারি সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রদর্শনী ও কৃষকের নিজ অর্থায়নেও চাষ করা হয়েছে। তুলার ভালো ফলন ও ন্যায্য দাম পাওয়ায় আগামীতে চাষির সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশা করছেন তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাসহ স্থানীয় কৃষকরা।
এবছর, উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের সাজু সাঈদ সিদ্দিকী বাছুর আলগা এলাকায় ১৫ বিঘা জমিতে তুলা চাষ করেছেন। এছাড়া মুনির আহমদ খোকন হালগড়াতে ২০ বিঘা, শফিকুল ইসলাম চক বড়ই গাছি এলাকায় ১২ বিঘা ও করিমুল ইসলাম ৪ বিঘাতে, কনক মিয়া গোয়ালের কান্দা এলাকায় ১০ বিঘা, জাংগিরার পাড় এলাকার আরিফুজ্জামান রঞ্জু ১০ বিঘা জমিতে তুলা চাষ করে এলাকার সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
কটন ইউনিট কর্মকর্তা মো. তোফায়েল আলম জানান, ২০১৫ সালে উপজেলায় সরকারি সহযোগিতায় পরীক্ষামূলকভাবে উন্নত জাতের তুলা চাষ শুরু হয়। ওই বছর কৃষকরা সিবি-১২ এবং হাইব্রিড প্রজাতির রুপালি-১ জাতের তুলার চাষ করছিলেন। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের আগ্রহ বাড়তে থাকে। এবছর কৃষকরা হোয়াইট গোল্ড-১, হোয়াইট গোল্ড-২, পালী-১, সিডিবি হাইব্রিড-১, সিবি-১৪ জাতের তুলা বেশি চাষ করেছেন। চন্দ্রকোণা ও চরঅষ্টধর ইউনিয়নের তুলা চাষীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসায় অন্যান্য এলাকার কৃষকরাও তুলা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তিনি আরো জানান, রূপালি-১, হোয়াইট গোল্ড-১ ও হোয়াইট গোল্ড-২ জাতের তুলা প্রতি বিঘাতে বীজসহ উৎপাদন হয় গড়ে ১৫ মণ থেকে ১৮ মণ করে। গত বছর প্রতিমন বীজ তুলার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩,৯০০ টাকা। চলতি মৌসুমে এখনও দাম নির্ধারণ করা হয়নি।
তুলা চাষিরা জানান, কৃষকদের জীবন মানের দিকে লক্ষ্য রেখে সকল পণ্যের বাজার মূল্যের সাথে তাল মিলানোর চিন্তা করলে গত বছরের তুলনায় এবছর অবশ্যই তুলার দাম বাড়াবেন যথাযথ কর্তৃপক্ষ। তারা আরো জানান, জমি তৈরি ও তুলার বীজ রোপণ থেকে শুরু করে বিক্রি করা পর্যন্ত প্রতি বিঘা জমিতে সব কিছু মিলিয়ে গড়ে ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলায় না পরলে প্রতি বিঘা তুলার আবাদ থেকে ৪৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা লাভ পাবেন বল কৃষকরা আশা করছেন।
তুলা চাষি আরিফুজ্জামান রঞ্জু জানান, তিনি কয়েক বছর ধরে তুলা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। বছর ১০ বিঘা জমিতে তুলা চাষ করেছেন। এতে লাভ বেশি পাওয়ায় কৃষকরা আগ্রহী হয়েছেন। তবে তুলা চাষে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ালে অনুর্বর, নিস্ফলা বা অনাবাদি অনেক জমিতে তুলা চাষ করে কৃষক পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব। চাষিদের মতে, নিস্ফলা জমিতে তুলা চাষ করায় একদিকে যেমন জমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে কৃষকরা অন্যান্য আবাদের চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন। তাদের পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা। তাই উপজেলার অনেক কৃষক ধান, গম, ভূট্টা, আলুসহ অন্যান্য আবাদের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় ওইসব ফসল ছেড়ে তুলা চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
সাব-ইউনিট কর্মকর্তা জানান, জাত ভেদে তুলার বীজ বুনতে হয় ৭.৫ কেজি থেকে ১৮ কেজি। বীজ বপনের ৬ মাস পর তুলা সংগ্রহ করা যায়। নকলার সব ইউনিয়নে তুলা চাষ করা সম্ভব। প্রত্যন্ত অঞ্চলে তুলা চাষ ছড়িয়ে দিতে তুলা উন্নয়ন বোর্ড ও বিভিন্ন প্রকল্প কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো কৃষিনির্ভর। এদেশের প্রায় ৬৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এখনো বিভিন্ন শস্য ও ফসল আমদানি নির্ভরতা কমেনি। এমন একটি কৃষি ফসল হলো তুলা। তুলা উৎপাদনে এদশে পিছিয়ে। তুলা একটি আন্তর্জাতিক মানের শিল্প ফসল, যা বিশ্বব্যাপী ‘সাদা সোনা’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮০ লাখ বেল তুলার চাহিদা রয়েছে, কিন্তু চাহিদার কম-বেশি ৫ শতাংশ দেশে উৎপাদন হচ্ছে।
বাংলাদেশে তিনটি শস্য মৌসুমের মধ্যে খরিফ-২ মৌসুমে কিছু জমিতে তুলা চাষ করা হয়। এই তুলা আবাদ থেকে তুলার আঁশ ছাড়াও ভোজ্যতেল, খইল, জ্বালানি উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। এ ভোজ্যতেলে খুব কম পরিমাণে কোলেস্টেরল থাকে এবং তুলার বীজ থেকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে তেল পাওয়া যায়; যা উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ এবং সয়াবিন তেলের চেয়েও পুষ্টিকর। আর তুলার খইলে ২৪ শতাংশ উচ্চ প্রোটিন পাওয়া যায়, ২০ শতাংশ হারে উচ্চফ্যাট ও ৪০ শতাংশ ক্রুড আঁশ; যা পশু ও মৎস্যখাদ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
তথ্য মতে, এই তুলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, ইতিহাস, সভ্যতা ও অর্থনীতি। মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্যের পরেই বস্ত্রের স্থান। আর এ বস্ত্রের প্রায় ৭০ ভাগ আসে তুলা থেকে। পৃথিবীতে তুলার ইতিহাস রচিত হয়ে আসছে সাত হাজার বছর পূর্ব থেকে। বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে, আর্য যুগ থেকে ব্রিটিশ আমলের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কার্পাসের চাষ হতো এবং ঘরে ঘরে চরকায় সুতা তৈরি হতো, তাঁতিরা কাপড় বুনে দেশের চাহিদা মেটাত।
তথ্য মতে, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব ভবন ছিল না, কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী তুলা উন্নয়ন বোর্ডের জন্য একটি নিজস্ব ভবনের জায়গা ও অর্থ বরাদ্দ দেন। এর পর থেকে তুলা চাষে একপ্রকার বিপ্লব শুরু হয়। এখন প্রতি বছর তুলা চাষির সংখ্যা ও আবাদের পরিমাণ শুধু বেড়েই চলছে। পোশাক খাতে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ তুলা বিদেশ থেকে এখনও আমদানি করতে হয়। তাই এদেশে তুলা আবাদ বৃদ্ধিতে সুনজর দেওয়া এখন সময়ের দাবী বলে অনেক মন্তব্য করেন। অনেকে জানান, যেখানে সারা বিশ্বে তুলা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। সেখানে এদেশে তুলার উৎপাদন মাত্র দুই লাখ বেলের মতো; যদিও আগে এক লাখ বেলের নিচে উৎপাদন হতো। সম্প্রতি তুলা উন্নয়ন বোর্ডের হাইব্রিড উন্নত জাতের তুলা উদ্ভাবন ও চাষের ফলে তুলা উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানিতে বছরে ২৪ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। যদিও আমদানিকৃত তুলা ভ্যালুঅ্যাডের মাধ্যমে সুতা ও কাপড়ের আকারে বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। এসব তুলা এ দেশে উৎপাদন করতে পারলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব বলে অনেকে মনে করছেন।
ময়মনসিংহ জোনের প্রধান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা ড. কৃষিবিদ খালেদা ইয়াসমিন-এঁর নির্দেশ মোতাবেক জামালপুরের তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা ইসরাইল হোসেনসহ কটন ইউনিট কর্মকর্তা ও সাব ইউনিট কর্মকর্তাগণ তুলার মাঠ পরিদর্শনসহ কৃষকদের নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরামর্শ সেবা দিচ্ছেন।
দেশব্যাপী তুলা চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালকসহ আঞ্চলিক কর্মকর্তা, সম্প্রসারিত তুলাচাষ প্রকল্পের কর্মকর্তাগণ, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের বিজ্ঞানী ও তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তাগণ, ইউনিট কর্মকর্তা ও সাব ইউনিট কর্মকর্তারা দেশব্যাপী আবাদ করা বিভিন্ন তুলার মাঠ পরিদর্শন করে চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ সেবা প্রদান করার পাশাপাশি উদ্বুদ্ধ করণ আলোচনা সভা করেছেন। এতে করে তুলা চাষের প্রতি কৃষকরা আগ্রহ বাড়ছে বলে মনে করছেন অনেকে। সুষ্ঠুভাবে তুলা সংগ্রহ করতে পারলে অনেক কৃষি পরিবার স্ববলম্বী হবেন। তাতে একদিকে বাড়বে কৃষি আয়, অন্য দিকে সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। ফলে আগামী বছর থেকে কিছুটা হলেও বেকারত্ব কমবে বলে মনে করছেন সুশীলজন।