সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে অশান্ত হয়ে উঠেছে কক্সবাজার শহর। দিনের আলোতেও শহরের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও ছিনতাইকারীদের হামলার শিকার হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে ছিনতাই রোধে জেলা পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। গত ২৫ দিনে পুলিশ গ্রেফতার করেছে ৪৭ জন ছিনতাইকারীকে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কক্সবাজার শহরের অন্তত ২০টি স্পটে সক্রিয় কয়েকটি ছিনতাইকারী চক্র। বিশেষ করে কক্সবাজার শহরের কলাতলী প্রাইমারি স্কুল, কলাতলী ডিভাইন রোড, সমুদ্রসৈকতের ঝাউবাগান, সৈকত পাড়া, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনে, কটেজ জোন, হোটেল কল্লোলের সামনে, জাম্বুর মোড়, হাসপাতাল সড়ক, পেট্রোল পাম্প, পান বাজার, গোলদিঘীর পাড়ে কবরস্থান রোড, বৈদ্যঘোনা ১০ তলার বিল্ডিংয়ের সামনে, বৌদ্ধ মন্দির গেইট, জাদিরাম পাহাড়ের উপরে, ক্যাং মাঠে, মাইক সার্ভিস রোড, খুরুশকুল রাস্তার মাথা, খুরুশকুল পুরাতন ব্রিজ, বিজিবি ক্যাম্পের আম গাছ তলা ও বাস টার্মিনাল এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় তারা দাপিয়ে বেড়ায়। এসব চক্র নানা কৌশলে সাধারণ মানুষ ও পর্যটকদের ওপর হামলা চালিয়ে ছিনতাই চালায়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ৯ জানুয়ারি কক্সবাজার শহরের ডিভাইন রিসোর্টের পাশে ছিনতাইয়ের শিকার হন আবরাহাম সহ তিন বন্ধু। তিন বন্ধু মিলে সৈকতে আড্ডা দিতে যান। ফেরার পথে ডিভাইন ইকো রিসোর্টের পাশে মাস্ক পরা পাঁচজন এসে তাদেরকে দিকে ছুরি চালায়। ছিনতাইকারীর দল মোবাইল ও মানিব্যাগ নিয়ে যায়। এর মধ্যে তুহিনের পায়ে বেশ কয়েকবার ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই দিন বৃহস্পতিবার সকালে কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কের এন্ডারসন রোডে এক এনজিওকর্মী ছিনতাইয়ের শিকার হন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিওতে দেখা গেছে ওই এনজিও কর্মীকে ভোরের আলোতে গতিরোধ করে। এক পর্যায়ে মাটিতে পেলে তাকে মারধর করে এবং মালামাল ছিনিয়ে নেয়। সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি রাত সাড়ে আটটার দিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে দুর্বৃত্তরা খুলনার কাউন্সিলর গোলাম রাব্বানীকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া গত শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) ভোরে কক্সবাজার শহরের গোলদিঘি পাড় এলাকায় মোবারক নামের টহলরত এক পুলিশ সদস্যকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় একদল ছিনতাইকারী চক্র। কক্সবাজারে শুধু ছিনতাইয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বাসা, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দুর্ধর্ষ চুরি সহ পার্কিং থেকে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাও নিত্যদিনের।
ভুক্তভোগী এনজিও কর্মী ইয়াসিন তোফা জানান, ঘটনার দিন ভোরে তার স্ত্রী কর্মস্থলে যাওয়ার সময় আমার বাসা থেকে ৫ মিনিট দূরত্বে খবর বিতান সড়কে তিনজন ছিনতাইকারী আমার স্ত্রীকে পেছন দিয়ে মুখ চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর তার বুকের উপর বসে গলায় ছুরি ধরে হাতে থাকা দুইটি স্বর্ণের আংটি ছিনিয়ে নেয়। এরপর ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে ব্যাপক মারধর করে। এক পর্যায়ে তাঁর স্ত্রী ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারান।
ছিনতাইসহ অপরাধ রোধে কাজ করা কক্সবাজার গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি'র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, 'গেল ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে ছিনতাই চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। ইতিমধ্যে গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির তিনটি পৃথক টিম মাঠে কাজ করছে। এবং পৃথক অভিযান চালিয়ে দুর্ধর্ষ কয়েকজন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে।
তিনি আরো বলেন, ডিবি পুলিশ অভিযানের পাশাপাশি, নিরাপত্তার স্বার্থে অস্থায়ী চৌকি বসিয়ে সন্দেহভাজন লোকজনদেরও তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) জসীম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশি কার্যক্রমে একটু ভাটা পড়েছে। এই সুযোগে অপরাধী চক্র মাথা চড়া দিয়ে উঠছিল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। অপরাধ নির্মূলে পুলিশ নিয়মিত কাজ করছে। তার ধারাবাহিকতায় গত ২৫ দিনে কক্সবাজার শহরের আলোচিত ৪৭ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চুরি, ছিনতাই সহ নানা অপরাধে ১১টি মামলা রুজু করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সাধারণ মানুষ দরজা খোলা রেখে ঘুমাতে পারাটাই কক্সবাজার জেলা পুলিশের তৃপ্তি।
শনিবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ জানান, তথ্যপ্রযুক্তি ও স্থানীয়দের সহায়তায় অভিযান চালিয়ে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ১২ জন পেশাদার ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতাকৃতরা হলেন, কক্সবাজার পৌরসভার টেকপাড়ার মাসুদ হোসেনের পুত্র তানভীর হোসেন প্রকাশ পেটান, প্রকাশ আজাদুর রহমান (২২), কক্সবাজার পৌরসভার পাহাড়তলী এলাকার মোঃ শফিকের পুত্র মোঃ ইসমাঈল (২০), পাহাড়তলী ইসুলের ঘোনার এলাকার মোঃ সরওয়ারের পুত্র ইমরান সরওয়ার ইমন (২১), টেকপাড়ার মোঃ ফরিদের পুত্র মো. ইরফান ফারদিন (২০), মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোমের খোন্দকার পাড়া এলাকার মো. হোছনের পুত্র সিহাব প্রকাশ খোকন (২৯), কক্সবাজার পৌরসভার সমিতিপাড়ার আবুল কাশেমের পুত্র মো. সোহেল (২৮), বৌদ্ধমন্দির এলাকার কৃষ্ণ চন্দ্র দাশের পুত্র সুমন কান্তি দাশ (২৫), কক্সবাজার পৌরসভার নতুন বাহারছড়া এলাকার মানিক মিয়ার পুত্র মো. হান্নান (১৯), পিটিস্কুল এলাকার মোঃ সেলিমের পুত্র সাইফুল ইসলাম (২৪) ও মো. হানিফের পুত্র মো. শাহীন প্রকাশ বুলেট (২২), পৌরসভার বাহারছড়ার মৃত ইসমাঈল মাঝির পুত্র হাসান মাহমুদ সাগর প্রকাশ ভিকি এবং টেকপাড়া চৌমুহনী এলাকার মোস্তফা কামালের পুত্র মিজবাউল হক মুন্না।
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, সন্ধ্যার পর শহরের বেশিরভাগ এলাকায় সড়ক বাতি নিভে যায়, যা ছিনতাইকারীদের সাহস জোগায়।
পেশাদার ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা দায়ের করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইলিয়াস খান।