ঢাকা শুক্রবার, ০৭ মার্চ ২০২৫, ২২ ফাল্গুন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঐতিহ্যের মৃৎশিল্পে রুটি রোজগার

ঐতিহ্যের মৃৎশিল্পে রুটি রোজগার

বাঙালি জাতির পুরোনো ঐতিহ্য সমূহের মধ্যে মাটির তৈজসপত্র বা মৃৎশিল্প অন্যতম। কিন্তু প্লাস্টিক, স্টিল, কাচ ও সিরামিক পণ্যের সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্যতার প্রভাবে পুরোনো এই ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে পূর্ব পুরুষের মৃৎশিল্পের এ পেশাকে এখনও ধরে রেখেছেন শেরপুরের নকলা উপজেলার গণপদ্দী ইউনিয়নের বিহাড়িরপাড় এলাকার পাল সম্প্রদায়ের অর্ধশত পরিবারের লোকজন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় দারিদ্র্য যেন পাল সম্প্রদায়ের পরিবারে নিত্যদিনের সঙ্গী। তাদের ঘরে প্রায়ই অভাব অনটন লেগে থাকে।

শীত মৌসুমের বাণিজ্য মেলা এবং শুষ্ক মৌসুম জানান দিচ্ছে দরজায় কড়া নাড়ছে পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যগত অনুষ্ঠান। আর সেইসব উৎসবকে ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। শুরু করছেন মাটির খেলনাসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরির কাজ। এই শিল্পের চাহিদা বছরের অন্য সময়ে কম থাকলেও, বাণিজ্য মেলা ও পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন মেলাতে মাটির তৈরি জিনিসপত্র ছাড়া যেন জমেই না। তবে প্লাস্টিক, স্টিল, কাচ ও সিরামিকের তৈরি দৃষ্টিনন্দন বাহারী পণ্যের দাপটে হাতের তৈরি মাটির পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। তাই মৃৎশিল্পীরা আগের মতো সারা বছর চরকা ঘুরিয়ে মাটির পণ্য তৈরি করেন না।

ইদ, পূজাসহ বিভিন্ন মেলা ও উৎসবে মাটির তৈরি পণ্য বেশি বিক্রি হয়। এসময় তারা মাটির গাছ, পশু-পাখি, ফুল-ফল, ফুলের টপ ও ফলমূলসহ বিভিন্ন বাসন কোসন বানিয়ে থাকেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে বিভিন্ন মাটির তৈরি খেলনার আকৃতি দিয়ে এবং নানান রং দিয়ে খেলনা সাজিয়ে তাদের পণ্যের চাহিদা বাড়ানোর চেষ্টা করেন।

সম্প্রতি পাল পাড়ায় সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মৃৎশিল্পী দীপ্ত রানি পাল, সূচনা পাল, নির্মল পাল, হাসা রানি পাল, মন চন্দ্র পাল, সুনীল পাল, পুষ্প রানি পাল, গৌতম চন্দ্র পাল, কাজল রানি পাল, বিপুল চন্দ্র পাল, সুলতা রানি পাল, দ্বিলীপ চন্দ্র পাল, মিলন রানি পাল, গদা রানি পালসহ শিক্ষার্থী বীথি রানি পাল, অর্পিতা রানি পাল ও অংকনা রানি পাল মাটির পণ্য তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। এরমধ্যে সুনীল পালের ছেলে প্রদীপ পাল চরকা ঘুরিয়ে মাটির পণ্যের আকৃতি দিচ্ছেন। কেউ হাতে পণ্য বানাচ্ছেন, কেউ কেউ পণ্য তৈরি করার জন্য মাটি মিশাচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা নতুন তৈরি করা ভিজা পণ্য রোদে শুকাতে দিচ্ছেন, কেউবা তুলি দিয়ে রং করাসহ পণ্যের গায়ে বিভিন্ন চিত্র ফুটিয়ে তুলছেন। আর ৭০ বছর বয়সি মৃৎশিল্পী শ্যামল চন্দ্র পাল ও খগেন চন্দ্র পাল সকলকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।

মৃৎশিল্পীরা হাত দিয়ে ইচ্ছামতো মাটির বিভিন্ন খেলনাসহ গাছ, পশু-পাখি, ফুল-ফল, ফুলের টপ ও ফলমূলের আকৃতি দিচ্ছেন; তৈরি করছেন মাটির ব্যাংকসহ বিভিন্ন বাসন কোসন। আগে এই এলাকার প্রায় শত পরিবার মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত থাকলেও, মাটির পণ্যের সার্বিক চাহিদা কমে যাওয়ায় অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। তবে শৌখিন লোকজনের ও শিশুদের চাহিদা মেটাতে অনেকেই বাপ দাদার এই পেশার ঐতিহ্যকে এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। শিক্ষার্থীরা ছুটিরদিন বা পড়ালেখার ফাঁকে মাটির পণ্য তৈরির কাজে মা-বাবাকে সাহায্য করে।

মৃৎশিল্পীদের দেয়া তথ্য মতে, তাদের তৈরি মাটির প্রতিটি পণ্যের আকার-আকৃতি ও গুরুত্বের উপর ভিত্তি করে পাইকারি প্রতিপিস ৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা করে এবং খুচরা প্রতিপিস ১০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা করে বিক্রি করা হয়। চাহিদা কম থাকায় সারা বছর কমকম বানানো হয়। মাটি ক্রয় করা, মাটি পরিবহণ করা, মাটি মিশানো, তৈরীকৃত পণ্যে রং করা, পুড়ানোসহ যে টাকা ব্যয় হয়। বিক্রি শেষে লাভ থাকেনা বললেই চলে। তাই এখন শুধুমাত্র এই পেশার আয় দিয়ে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার খরচ চালানো সম্ভব হয়না। বাধ্য হয়েই সবাই এই পেশার পাশাপাশি বিভিন্ন পেশায় মনোনিবেশ করেছেন।

মৃৎশিল্পী শ্যামল চন্দ্র পাল জানান, এই শিল্পের প্রধান উপকরণ মাটি। তাই নীচু এলাকার কৃষকের ক্ষেত থেকে মাটি কিনে তা সংগ্রহ করে মজুদ করে করে রাখতে হয়। পরে পণ্য বানানোর জন্য প্রয়োজনমতো মাটি উপযোগী করা হয়। চাকার (চরকা) মাধ্যমে বা হাতে এসব উপযোগীকৃত মাটিকে গাছ, পশু-পাখি, ফুল-ফল, ফুলের টপ ও ফলমূলসহ বিভিন্ন বাসন কোসনের আকৃতি দেওয়া হয়। তারপর তৈরিকৃত মাটির জিনিস পত্রগুলো বিশেষ কৌশলে আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করা হয়। এর পরে তাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে রং দেওয়ার কাজ শেষ করে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয়।

অন্য এক মৃৎশিল্পী খগেন চন্দ্র পাল জানান, প্রায় ৩-৪ যুগ ধরে মাটির বাসন কোসনের চাহিদা কমতে থাকলেও মাটির টপ ও খেলনা সামগ্রীর চাহিদা এখনো কমেনি। ইদ ও পূজাসহ বিভিন্ন মেলা ও উৎসবে মাটির তৈরি পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে। এসব উৎসবের সময় ঘনিয়ে এসেছে তাই এখন তাদের দিন রাত কাজ করতে হচ্ছে।

শিক্ষিত নারী মৃৎশিল্পী অর্পিতা রানী পাল জানান, প্রতিটি পহেলা বৈশাখ ও বিভিন্ন মেলাসহ ঐতিহ্যগত অনুষ্ঠানে আমাদের মাটির তৈরি জিনিসপত্র বেশি বিক্রি হয়। মেলাকে সামনে রেখে আমরা দিন-রাত পণ্য তৈরি করছি। তবে এখন এই পেশার আয়ে সংসার চলেনা। তাই অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন আর আগের মত দিন রাত চরকা ঘুরানোর কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় না। ঐতিহ্যবাহী এই পেশাকে ধরে রাখতে সরকারি সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

সরকারি আর্থিক সহযোগিতা পেলে বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারতেন কারিগররা। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে এই শিল্পের দিকে সরকার ও বিত্তবানদের সুনজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘যে বা যারা এখনো এসব শৈল্পিক কাজ করেন, তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে ও প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার পাশাপাশি সহজে বাজারজাত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা জরুরি।’

তথ্যপ্রযুক্তির অত্যাধুনিক যুগে দেশে বিভিন্ন কারণে মাটির তৈরি জিনিসের চাহিদা কমেছে; বেড়েছে প্লাস্টিক, স্টিল, কাচ ও সিরামিক পণ্যের চাহিদা। ফলশ্রুতিতে দিন দিন আর্থিক সংকটে পড়ছেন মৃৎশিল্পীরা। এতে জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। সরকারি সহযোগিতার জন্য একাধিকবার নামের তালিকা নিলেও কোন প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি বলেও এই এলাকার মৃৎশিল্পীদের অনেকেই অভিযোগ জানিয়েছেন। দেশের এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতাসহ সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন তারা।

যুগ যুগ ধরে চলে আসা পরিবেশবান্ধব নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় ও বাণিজ্যিক সামগ্রী তৈরির এ ক্ষুদ্র শিল্পগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার দাবি সংস্কৃত ব্যক্তি ও সুশীল জনসহ পরিবেশ চিন্তকদের।

রোজগার,রুটি,ঐতিহ্য,মৃৎশিল্প
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত