কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দুধকুমার নদের ওপর সোনাহাট স্থলবন্দরগামী সড়ক সেতুটির কাজ কচ্ছপ গতিতে। দেড়শ বছরের পুরানা রেল সেতু দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল করে ৬টি ইউনিয়নের কয়েকলাখ মানুষ। দুই বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্মাণকাজের সময়সীমা চার দফা বাড়িয়ে ৬ বছরেও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সময় ও প্রকল্প ব্যয় বাড়লেও ছয় বছরে ১৩৬ কোটি টাকার সেতুর নির্মাণকাজ হয়েছে মাত্র অর্ধেক। এতে দেশের ১৮তম সোনাহাট স্থলবন্দর হতে পণ্য আমদানি-রপ্তানি এবং কচাকাটা থানাসহ ৬টি ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষকে দেড়শ বছরের পুরানা রেল সেতু দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল করতে হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) বলছে, জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, নকশা পরিবর্তন ও করোনাকালীন স্থবিরতাসহ ঠিকাদারের কাজে ধীরগতির কারণে সেতু নির্মাণ শেষ করতে চারবার সময় বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ছয় কোটি টাকার বেশি। গত ছয় বছরে কাজ সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ৫৩ শতাংশ। বাকি কাজ শেষ করতে আরো দেড় বছর সময় বাড়ানো হয়েছে। এই সময়ে কাজ শেষ হলে আগামী ২০২৬ সাল নাগাদ সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া যাবে।
কিন্তু এলাকাবাসী জানিয়েছে, যে ধীর গতিতে সেতু নির্মাণের কাজ চলছে, তাতে আগামী দেড় বছরেও এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
দীর্ঘ দিনেও সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় দেড়শ বছরের পুরানা রেল সেতু দিয়ে দিয়ে সোনাহাট স্থল বন্দরের পাথরসহ অন্যান্য মালামাল বোঝাই ট্রাক ও যানবাহন ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে চলাচল করছে। দুর্ঘটনা এড়াতে উপজেলা প্রশাসন, সওজ বিভাগ, স্থল বন্দরের ব্যবসায়ী, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি তদারকি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদারকি কমিটি পুরানা সেতুর ওপর দিয়ে ৪০০ সেফটির বেশী পাথর বোঝাই ট্রাক চলাচল করতে পারবেনা বলে বিধি নিষেধ আরোপ করলেও অনেকে এ নিয়ম মানছেনা। ফলে যে কোনো সময় সেতুর পাটাতন ভেঙ্গে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।
উল্লেখ্য, ১৮৭৯ সালে তৎকালীন নর্দার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে, বেঙ্গল ও আসামের সঙ্গে যোগাযোগ সুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পাইকেরছড়া ও সোনাহাট ইউনিয়নে প্রান্তে দুধকুমার নদের ওপর সোনাহাট রেলসেতু নামে একটি সেতু নির্মাণ করে। ব্রিটিশ শাসনামল শেষে ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির পর সেতুটির রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক-হানাদার বাহিনী যাতে নদী পার হতে না পারে, সেজন্য সেতুর দুটি অংশ মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।
এরপর ১৯৮৭ সালে স্টিলের স্লিপার দিয়ে মেরামত করে বেইলি সেতু হিসেবে চালু করা হয়। বর্তমানে এই সেতু দিয়ে সোনাহাট স্থলবন্দর থেকে পণ্যবাহী যানসহ অন্যান্য যানবাহন ৬টি ইউনিয়নের কয়েকলাখ মানুষ চলাচল করছে। ইতিমধ্যে সওজ বিভাগ সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে।
স্থলবন্দর ও দুধকুমার পূর্বপাড়ের মানুষের নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে ২০১৯ সালে বেইলি সেতুর কিছুটা ভাটিতে দুধকুমার নদের ওপর ৬৪৫ দশমিক শূন্য ১৫ মিটার দীর্ঘ নতুন সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে সওজ। এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড এবং ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড যৌথভাবে নির্মাণকাজ করছে। ১৩৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকার চুক্তিতে শুরু হওয়া সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে ছয় বছরে তা শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সোনাহাট স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী আবুল হোসেন, সাইফুর রহমান, নুর হোসেন ও জহুরুল ইসলাম জানান, নতুন সেতুর অভাবে স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় সরকারের কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় পূরণ হচ্ছে না। পুরোনো রেলসেতু দিয়ে পর্যাপ্ত মালামাল পরিবহনের করতে না পেরে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে ব্যবসায়ীরা। গাড়ি ঠিকমতো লোড করে সেতু পার হওয়া যায় না। একবার একদিকে আরেকবার আরেকদিকে কাত হয় গাড়ি। জানমালের ঝুঁকি নিয়া চলতে হয়। দ্রুত নতুন সেতুর কার্যক্রম শেষ করার দাবি জানান তারা।
সওজের কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পুরাতন সেতুটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। নতুনটির সেতুটির কাজ প্রায় ৫৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। পাইলিং শেষ করে কিছু গার্ডার নির্মাণ শেষ হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে প্রকল্পের মেয়াদ অর্থাৎ ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবো বলে আশা করছি।’