শেরপুরের গারো পাহাড়ে পিকনিক বাসের সাউন্ড বক্স ও হর্ণের শব্দ দূষণে জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হয়ে পরেছে। সাউন্ড বক্সের শব্দে পর্যটন কেন্দ্রে আগত সাধারণ ভ্রমণ পিপাসু, পর্যটন কেন্দ্রের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি, আশপাশের এলাকায় বসবাসকারীদের টিকে থাকাটাই দায় হয়ে পরেছে।
জানা গেছে, একসময় গারো পাহাড়ের বনাঞ্চলে নানা প্রজাতির পশুপাখি ও জীবজন্তুর অভয়ারণ্য ছিল। প্রতিবছর শীত মৌসুমে অতিথি পাখিরও আগমন ঘটতো পাহাড়ের খালবিল, ঝরনা ও জলাশয়গুলোতে। পশুপাখির কোলাহলে মুখরিত ছিল গারো পাহাড়।
কিন্তু কালের বিবর্তনে বনের জমি বেদখল,পাহাড় থেকে অবৈধভাবে বালু পাথর উত্তোলন ও বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার পাশাপাশি নানা কারণে গারো পাহাড়ের জীববৈচিত্র্যও আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। শেরপুরের সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও থেকে ঝিনাইগাতী হয়ে শ্রীবরদী উপজেলার কর্ণঝোড়া পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রায় ৩০ হাজার একর বনভূমিতে রিজার্ভ ফরেস্টের শালগজারী, ওষুধি বৃক্ষসহ বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির প্রাকৃতিক বৃক্ষে ভরপুর ছিল গারো পাহাড়। পরিবেশবিদ ও স্থানীয়দের মতে ওই সময় পশুপাখি, নানা প্রজাতির প্রাণী ও জীবজন্তুর কোলাহলে গারো পাহাড় ছিল মুখরিত।
ছিল পশুপাখি ও জীবজন্তুর অভায়রন্য। কিন্তু প্রাকৃতিক বন উজাড়, বনের জমি বেদখল, বনের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত নদী নানা ঝর্ণা ও জলাশয় থেকে বালু পাথর উত্তোলনসহ নানা কারণে গারো পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। জানা যায়, ৯০ দশকের পর গারো পাহাড়ে বসবাসকারী দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সামাজিক বন সৃজনের কাজ হাতে নেয় সরকার। অভিযোগ রয়েছে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে স্বল্প সময়ে বর্ধনশীল বিদেশি প্রজাতির উডলড বাগান সৃজন করা হয়। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এসব উডলড বাগান সৃজনে অংশীদারগণ লাভবান হলেও ক্ষতির সম্মুখীন হয় বন বিভাগ।
স্থানীয়রা জানান বিদেশি প্রজাতির এসব উডলড গাছে কোন পশুপাখি পর্যন্তও বসে না। ফলে সেসময় থেকে বিলুপ্তি ঘটতে থাকে গারো পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য। শুধু তাই নয়, সামাজিক বনের অংশীদারদের মাধ্যমেই বনের জমি বেদখলের প্রতিযোগিতাও শুরু হয়। বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে,বনবিভাগ সৃষ্টির পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার একর বনের জমি জবরদখলকারীদের হাতে বেদখল হয়েছে। সংকুচিত হয়ে পরেছে বন ও বনভূমি। এছাড়া ৯০ দশকের পর থেকে গারো পাহাড়ের মধুটিলা ইকোপার্ক, ও গজনী অবকাশ বিনোদন কেন্দ্র নামে ২ টি পিকনিক স্পট গড়ে তোলা হয়েছে।
গজনী অবকাশ বিনোদন কেন্দ্রটি নিয়ন্ত্রণ করে জেলা প্রশাসন। মধুটি ইকোপার্ক নিয়ন্ত্রণ করে বনবিভাগ। এসব পিকনিক স্পটগুলোতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে। পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে গারো পাহাড়। যদিও এসব বিনোদন কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতিবছর সরকারের ঘরে আসে কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব।এসব বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে হয়েছে অনেকের কর্মসংস্থানের ও ব্যবস্থা। সারাদেশে বেড়েছে শেরপুরের গারো পাহাড়ের পরিচিতি।
কিন্তু বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে আগত শতশত পিকনিক বাসে থাকা সাউন বক্স ও বাসের বেপরোয়া হর্ন শব্দ দূষণে পরেছে গারো পাহাড়। প্রতিনিত গারো পাহাড়ে চলছে এখন গাড়ির হর্ণ ও সাউন্ড বক্সের শব্দ দূষণ। এতে পর্যটন কেন্দ্রে আগত দর্শনার্থীদের পাশাপাশি গারো পাহাড়ে বসবাসকারীরা রয়েছেন চরম বিপাকে। এ অবস্থা চলছে গারো পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে হর্ন বাজানো নিষেধ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হলেও এর কোনো বাস্তবায়ন নেই।
উপজেলা প্রশাসন ও বনবিভাগের পক্ষ থেকে এসব শব্দ দূষণ রোধে কোন প্রকার উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে না। ফলে দিনেদিনে গারো পাহাড়ের অবশিষ্ট জীব বৈচিত্র্যও এখন হুমকির সম্মুখীন। বনবিভাগের মধুটিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো,রফিকুল ইসলাম বলেন, গারো পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই মানছে না পর্যটকরা। তিনি বলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কথা হয়েছে শব্দদূষণ রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। বনবিভাগের রাংটিয়া ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা মো, আব্দুল করিম বলেন,গজনী বিনোদন কেন্দ্রটি পরিচালিত হয় জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন।
তিনি বলেন শব্দ দূষণে গারো পাহাড়ের জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। বনবিভাগের পক্ষ থেকেও চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া বনবিভাগের এতো লোকবল নেই শব্দ দূষণ প্রতিরোধ করার মতো। ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো,আশরাফুল আলম রাসেল বলেন বিনোদন কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়ার পরেও পর্যটকরা তা মানছে না। তিনি বলেন এব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।