শেরপুরের নকলায় শীতকালীন সবজিসহ প্রায় সব ধরনের ফসলের খেতে মৌসুম ভেদে চাষ উপযোগী সাথী ফসল আবাদ করে বাড়তি আয়ের পথ খোঁজে পেয়েছেন কৃষকরা। এমন একজন হলেন উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের বাছুর আলগা উত্তর পাড়া এলাকার কৃষক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম।
তিনি অধিক লাভের আশায় রমজান মাসকে সামনে রেখে ২৫ শতাংশ জমিতে বেগুনি তৈরির উপযোগী দেশী জাতের ছোট বেগুন (জুনকী বেগুন) চাষ করেছেন। আর বেগুন গাছের সাঁড়ির ফাঁকে রোপণ করেছেন ডাটা। কয়েক বছর ধরে পতিত জমিতে চাষ করা বিভিন্ন ফসলের গাছের ফাঁকে বিভিন্ন জাতের শাক সবজি চাষ করে আসছেন। মিশ্র এই চাষে বাড়তি আয়ের পথ খোঁজে পেয়েছেন তিনি। মৌসুমি ফসলের সাথে মিশ্র আবাদ হিসেবে বিভিন্ন জাতের শাক সবজি চাষ করে এলাকাবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সামান্য জমিতে ব্যতিক্রমী এই মিশ্র আবাদে তিনি বাড়তি যে আয় করছেন, তা অন্যকোনো ভাবে সম্ভব নয়। তার দেখাদেখি এলাকার ছামিলদুল ১০ শতাংশে, মোজাফর ২০ শতাংশে, ইয়াজ উদ্দিন ১৫ শতাংশে ও নূর হক ১০ শতাংশে, ময়নাল ২০ শতাংশে, আব্দুর রহিম ১০ শতাংশ জমিতে বেগুন চাষ করেছেন এবং তারা সবাই বেগুনের সাথী ফসল হিসেবে স্বল্পকালীন বিভিন্ন শাক-সবজি চাষ করেছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাছুর আলগা উত্তর পাড়া এলাকার চান মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বাড়ির পাশের ২৫ শতাংশ দোআঁশ মাটির জমিতে জানুয়ারি মাসে দেশী জাতের ছোট বেগুন (জুনকী বেগুন) লাগিয়েছেন। প্রতিটি সারির গাছের ফাঁকে যথেষ্ট ফাঁকা রয়েছে। ওই ফাঁকা জায়গায় তিনি স্বল্পকালীন ডাটার বীজ বপন করেছেন। বেগুন গাছে ফুল আসা শুরু হয়েছে, পাশাপাশি ডাটাও বেশ বড় হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে ডাটা বিক্রির উপযোগী হবে। আর কোন প্রাকৃতিক সমস্যায় না পরলে বেগুন বিক্রি শুরু হবে রমজানের প্রথম সপ্তাহ থেকে।
কৃষক নজরুল ইসলাম জানান, জমি তৈরি করতে চাষ বাবদ এক হাজার টাকা, গোবর ২ হাজার ৪০০ টাকা, চাষের মধ্যে ও চারা রোপণের পরে রাসায়নিক সার (ইউরিয়া, ডিএপি, এমপিও, জিপসাম ইত্যাদি) বাবদ ১০ হাজার টাকাসহ এপর্যন্ত মোট ১৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। খেতে ভেড়া, সেচ ও সার দেওয়া এবং শ্রমিক মজুরিসহ বেগুন তোলা পর্যন্ত তার ২৫ শতাংশ জমিতে অন্তত ৫০ হাজার টাকা খরচ করতে হবে বলে তিনি মনে করছেন। তিনি আরো জানান, বেগুনের সাথী ফসল হিসেবে ডাটা বিক্রি থেকে ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা বাড়তি আয় হবে। আর বেগুনের দাম ভালো থাকলে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং দাম অপেক্ষাকৃত কম থাকলে অন্তত লাখ টাকার বেগুন বিক্রির আশা করছেন তিনি। নজরুল ইসলাম আরো জানান, তিন বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে বেগুন ও আলু খেতে সাথী ফসল হিসেবে লাউ, কুমড়াসহ বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করে ব্যাপক সফলতা পান। এরপর থেকে প্রতি মৌসুমি ফসলে সাথী ফসল চাষ করেন। গত বছর ২০ শতাংশ বেগুন খেতের ডাটা ও লাল শাক বিক্রি করেছেন প্রায় ৮ হাজার টাকা। যা পুরোটাই বাড়তি আয়।
অন্য এক কৃষক নূর হক জানান, তিনি পল্লি বিদ্যুতের লাইন ম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন। তাই কৃষি কাজে বেশি সময় দিতে পারেন না। তবে অফিসে যাওয়ার আগে ও অফিস থেকে ফিরে তার বাড়ির আঙ্গিনার ২০ শতাংশ জমিতে বিভিন্ন শাক সবজি চাষ করেন এবং প্রতি আবাদে মিশ্র ফসল চাষ করেন। বর্তমানে তার ১০ শতাংশ জমিতে গোলআলু চাষ করেছেন এবং সেখানে মিষ্টি লাউ ও চাল কুমড়া রোপণ করেছেন। আলু তোলা শেষ হয়েছে। ওই খেতের প্রতিটি লাউ ও কুমড়া গাছে ফুল আসা শুরু হয়েছে। রমজানের শুরু থেকেই লাউ কুমড়া ভালো দামে বিক্রি করা যাবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিত ভাবে আবাদ করলে একই জমিতে বছরে কমপক্ষে ৫বার বিভিন্ন শাক সবজি চাষ করা যায়। মিশ্র শাক সবজি চাষে যে আয় হয়, তাতে অন্য কোন আবাদে সম্ভব নয়। তাই দিন দিন সব এলাকার কৃষকরা মিশ্র আবাদের দিকে ঝুঁকছেন। বিশেষ করে মধ্যম মেয়াদী ফসলের আবাদে স্বল্প কালীন শাক সবজি চাষে কৃষকের আগ্রহ আকাশচুম্বী।’
ভূরদী খন্দকার পাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলহাজ্ব ছায়েদুল হক জানান, তারা চলতি মৌসুমে মধ্যম মেয়াদী ফসলের সব আবাদে স্বল্প কালীন শাক সবজি চাষ করে বাড়তি আয় করছেন। তাদের দেখা দেখি আশেপাশের এলাকার কৃষকরাও উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। চাষীরা দিন দিন এমন লাভজনক সাথী ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। তাছাড়া কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রতি মাসে অন্তত একবার আলোচনা সভা করেন বলেও তিনি জানান। মিশ্র আবাদে অল্প পরিশ্রম ও একই সার ও সেচে কয়েকটি ফসল পাওয়া যায়। ফলে কৃষকরা আশাতীত লাভবান হচ্ছেন।
কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার সদস্য ইসমাইল হোসেন জানান, তাদের কোন আবাদে অধিক লাভের আশায় অপ্রয়োজনে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন না। কৃষি বিভাগের পরামর্শে ফেরোমন ফাঁদ ও জৈব সার ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক উপায়ে পোকা ও রোগ বালাই দমন করেন তারা। ফলে তাদের উৎপাদিত শাক-সবজি, ফুল-ফল সম্পূর্ণ নিরাপদ। তাই তাদের উৎপাদিত শাক সবজি ও ফুল ফলের চাহিদা ও দাম অন্য সবার চেয়ে একটু বেশি থাকে বলে অনেকে জানান।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মোরসালিন মেহেদী জানান, কৃষকদের মিশ্র পদ্ধতিতে আবাদ করতে নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। চাষিদের যেকোনো সমস্যায় দ্রুত সমাধান দিতে কৃষি বিভাগ সদা তৎপর রয়েছে বলেও তিনি জানান। তিনি আরো জানান জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ও একই জমিকে একই সময়ে বিভিন্ন আবাদের মাধ্যমে ব্যবহার করতে কৃষকদের নিয়ে মাঠ দিবস করাসহ তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রাপ্যতা অনুযায়ী কৃষি প্রণোদনা দেওয়া হয়। একই জমিতে রোপণ করা দীর্ঘ মেয়াদী ফল গাছের ফাঁকে এক সাথে ও একই খরচে শাক-সবজি ও অন্যান্য স্বল্প কালীন আবাদ করে যে কেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন বলে মন্তব্য করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।