ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রোহিঙ্গাদের ধুলো দিয়ে সন্ত্রাসবাদে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ

রোহিঙ্গাদের ধুলো দিয়ে সন্ত্রাসবাদে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ

আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি। পাকিস্তানে জন্ম নেয়া এই রোহিঙ্গা নাগরিক আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান। তাঁর নেতৃত্বে আরসার সদস্যরা রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পকে অস্থির করে তুলেছিল। তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ধুলো দিয়ে সন্ত্রাসবাদ চালিয়ে আসছিলেন। হত্যাকাণ্ড, চাঁদ দাবি, অপহরণ, এমনকি প্রত্যাবাসনে বাঁধা দেয়ার অভিযোগ উঠে আতাউল্লাহ ও আরসার বিরুদ্ধে।

এসব ঘটনায় বরাবরই আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। আতাউল্লাহ কখনো থাকতেন সীমান্তের ওপারে, কখনো অবস্থান ছিল ক্যাম্পে। এনিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। তবে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জালে ধরা পড়েছেন আরসা প্রধান।

আতাউল্লাহর নামটি প্রথম বারের মতো আলোচনায় আসে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর। ওই দিন মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বড় ধরনের সশস্ত্র হামলা সংঘটিত হয়। যেখানে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বিজিপির ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হয়েছে। হামলার এক সপ্তাহ পরে এই আতাউল্লাহ এক ভিডিও বার্তা নিয়ে অনলাইন মাধ্যমে নিজকে পরিচিত করে দেন। তিনি মিয়ানমার সীমান্তের বিজিপি পোস্টে হদায় স্বীকার করেন এবং প্রথম বারের মধ্যে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা নামের এক বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সম্পর্কে অবহিত করেন। বলেন, তিনিই আরসার প্রধান। এরপর আরসা থেকে অনলাইনে প্রকাশিত হওয়া বিভিন্ন ভিডিওতে আতাউল্লাহ সামনে এসেছেন এবং সেখানে তিনি প্রেস বিবৃতি ও বক্তব্য দিয়েছেন।

বিভিন্ন মাধ্যমে ও উইকিপিডিয়ার প্রাপ্ত তথ্য বলছে, আতাউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন পাকিস্তানের করাচিতে। তবে তার পরিবার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী। ১৯৬০-এর দশকে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে তার পরিবার পাকিস্তানে আশ্রয় নেয় এবং পরে সৌদি আরবের মক্কায় বসবাস শুরু করে। জন্ম ১৯৭৭ সালে। বাবা গোলাম শরীফ। সাত ভাই ও দুই বোনের মধ্যে অষ্টম তিনি। ৬ বছর বয়সে চলে যান সৌদি আরবের রিয়াদে। ইসলামি শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতা করেন মক্কা ও রিয়াদে। সেখানে তিনি ইসলামী শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ইমাম হিসেবে কাজ করেন। ২০১২ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুরু হলে আতাউল্লাহ সৌদি আরব ত্যাগ করেন এবং রোহিঙ্গা প্রতিরোধ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৩ সালে আরসার প্রধান হিসেবে যোগ দেন।

২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) জানায়, আতাউল্লাহ পাকিস্তানে তালেবানের অধীনে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং লিবিয়াতেও অতিরিক্ত সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।

আতাউল্লাহর নেতৃত্বে ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের পুলিশ পোস্টে হামলা চালানো হয়। যেখানে কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় বড় ধরনের হামলায় ৭১ জন নিহত হয়। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালায়। এতে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানে ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা (স্কোয়াড্রন লিডার) রিজওয়ান রুশদী হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি আরসার প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ।

গত ১৮ মার্চ র‌্যাব আতাউল্লাহকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকালে তাদের কাছ থেকে নগদ ২১ লাখ ৩৯ হাজার ১০০ টাকা, একটি চাকু, ধারালো স্টিলের মোটা চেইন ও চারটি হাতঘড়ি জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুরে র‍্যাবের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও অবৈধ অনুপ্রবেশ আইনে পৃথক দুটি মামলা করা হয়।

আদালতের সরকারি কৌঁসুলি খোরশেদ আলম মোল্লা সাংবাদিকদের জানান, গোপন বৈঠক করার সময় র‍্যাব অভিযান চালিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে ছয়জন এবং ময়মনসিংহ থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

তিনি বলেন, সংঘবদ্ধভাবে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গুপ্তচরের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে ষড়যন্ত্র করার জন্য অশুভ পাঁয়তারার চেষ্টাকালে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

খোরশেদ আলম মোল্লা বলেন, তাঁরা অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। তাদের পাসপোর্ট বা কোনো ভিসা নেই। অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢুকে অপকর্ম করতে পারে, তাঁরা কোন উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করল, তাঁদের অশুভ পরিকল্পনা জানতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রিমান্ডের আবেদন করেন। আদালত ছয় আসামিকে পাঁচ দিন করে মোট ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

মামলার সংক্ষিপ্ত এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত ১৬ মার্চ দিবাগত রাত ১০টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সিদ্ধিরগঞ্জের ভূমিপল্লী আবাসিক এলাকায় ও ময়মনসিংহ সদর থানার নতুন বাজার মোড় এলাকার গার্ডেন সিটিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির কতিপয় সদস্য নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও অপরাধ সংঘটনের লক্ষ্যে গোপন বৈঠক করছে-এমন সংবাদের ভিত্তিতে নারী-শিশুসহ ওই ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আগেও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও গুরুতর অপরাধ সংঘটনের লক্ষ্যে গোপন বৈঠকের ধারাবাহিকতায় তারা ওই বৈঠক করছিলেন। পরে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

আতাউল্লাহর গ্রেপ্তার রোহিঙ্গা সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) নেতা আতাউল্লাহ যেন এক আতঙ্কের নাম। তার বেপরোয়া সিদ্ধান্তের কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা হয়েছে বাস্তুচ্যুত। রোহিঙ্গাদের কাছে আতাউল্লাহ যেন এক অভিশাপের নাম।

আতাউল্লাহর নির্দেশেই রোহিঙ্গা নেতা মুহিব্বুল্লাহ হত্যা

রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিব্বুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছিল আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির নির্দেশেই। গ্রেপ্তারের পর আরসার শীর্ষ নেতা নুর কামাল ওরফে সমিউদ্দিনের বরাতে ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর এসব তথ্য জানায় র‍্যাব-১৫।

র‌্যাব জানায়, রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের পক্ষে থাকায় মুহিব্বুল্লাহর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল আরসা। সংগঠনের প্রধান আতাউল্লাহ তাকে মিয়ানমারে আরসার সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেন, কিন্তু তিনি রাজি না হওয়ায় তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের এক বৈঠকে মুহিব্বুল্লাহ হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। দুই দিন পর, ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ১২ জনের একটি কিলার গ্রুপ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে মুহিব্বুল্লাহর কার্যালয়ে প্রবেশ করে এবং তাকে গুলি করে হত্যা করে।

ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা হত্যা

২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের কাছে মাদকবিরোধী অভিযানে নামে র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ের বিশেষ একটি দল। এ সময় আরসা সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হন ডিজিএফআইয়ের স্কোয়াড্রন লিডার রিজওয়ান রুশদী। গুলিবিদ্ধ হন র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)-১৫ কক্সবাজারের সদস্য সোহেল বড়ুয়া। এ ছাড়া গুলিতে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে সাজেদা বেগম (২০) নামের এক রোহিঙ্গা তরুণীও নিহত হন।

পুলিশ জানায়, ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় ডিজিএফআই কক্সবাজার কার্যালয়ের মাঠ কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে আরসার প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনীসহ ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ৩০-৩৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে গত ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মাহফুজ ইমতিয়াজ ভূঁইয়া আরসার প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহসহ ৪৯ জনের বিরুদ্ধে বান্দরবান চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন। হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হয়েছে। এখন বিচারিক কার্যক্রম চলছে।

আরসা,আতাউল্লাহ,রোহিঙ্গা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত