চরাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের অন্যতম প্রধান বাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়ি এখনো টিকে আছে। এই বাহনের ওপর নির্ভর করেই চরাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। রংপুর বিভাগের আটটি জেলায় ২৬২টি ছোট-বড় নদী রয়েছে, যার বুকে গড়ে উঠেছে প্রায় ৫৬২টি চর। এসব চরে ৩২ ধরনের ফসল উৎপাদন হয়।
রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন নদ-নদীর বুকে গড়ে ওঠা চরে পণ্য পরিবহনের জন্য ঘোড়ার গাড়ি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক সময় এসব এলাকায় মহিষের গাড়ির প্রচলন ছিল, তবে বর্তমানে তা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন প্রতিটি চরে ১০ থেকে ৫০টি ঘোড়ার গাড়ি চলাচল করে।
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলের ঘোড়ার গাড়ি চালক রাজু ইসলাম জানান, একটি ঘোড়া কিনতে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাগে এবং একটি ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করতে ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। প্রতিটি গাড়িতে ১০-১৫ মণ পণ্য পরিবহন করা যায় এবং ৩-৪ কিলোমিটার বালুচরে প্রতি মণ পণ্য পরিবহনে ৮০-১০০ টাকা নেয়া হয়। তবে ঘোড়াকে সুস্থ রাখতে একবারে ৭-৮ মণের বেশি মাল পরিবহন করা হয় না।
কুড়িগ্রামের চরের ঘোড়ার গাড়ি চালক ইসলাম (৪৮) জানান, প্রতিদিন তিনি ১,২০০-১,৫০০ টাকা আয় করেন, যদিও ঘোড়ার খাদ্য বাবদ প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা খরচ হয়। বছরের আট মাস শুকনো মৌসুমে ঘোড়ার গাড়ি চরাঞ্চলের প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে বর্ষাকালে এর ব্যবহার কমে যায়।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা নদীর চরের মেহের আলী (৪৮) বলেন, "চরাঞ্চলে শত শত পরিবারের জীবিকা ঘোড়ার গাড়ির ওপর নির্ভরশীল। শুকনো মৌসুমে এটি চরের প্রধান বাহন হলেও বর্ষাকালে নৌকাই মূল পরিবহন মাধ্যম হয়ে ওঠে।"
চরাঞ্চলে উৎপাদিত বাদাম, মিষ্টি আলু, মিষ্টি কুমড়া, আলু, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসতে ঘোড়ার গাড়িই একমাত্র ভরসা। কুড়িগ্রামের চর উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক ইসলাম বেবু বলেন, "নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় নৌকা সহজে চলাচল করতে পারে না, তাই শুকনো মৌসুমে ঘোড়ার গাড়িই একমাত্র বাহন। চরের অর্থনীতি পুরোপুরি এই বাহনের ওপর নির্ভরশীল।"
রংপুর কৃষি বিভাগ জানায়, বিভাগের আট জেলায় ৯১ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ হয় এবং এসব চরে ৩২ ধরনের ফসল উৎপাদন হয়। কৃষিবিদ ড. মোহাম্মদ আলী বলেন, "ঘোড়ার গাড়ি না থাকলে চরাঞ্চলে পণ্য পরিবহন করা কঠিন হতো। দুর্গম চর থেকে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল সহজে বাজারজাত করতে পারছে এবং ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে। এছাড়া, ঘোড়ার গাড়ি চালানো অনেকের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করেছে।"
চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করতে এবং অর্থনৈতিক প্রবাহ বজায় রাখতে ঘোড়ার গাড়ি এখনো অপরিহার্য। বিশেষ কোনো বিকল্প বাহন না আসা পর্যন্ত এটি চরের মানুষের অন্যতম ভরসা হয়ে থাকবে।