বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এবারের ঈদুল ফিতরের ছুটিতে এক ব্যতিক্রমী চিত্র দেখা গেছে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে। ঈদের লম্বা ছুটিকে ঘিরে রেকর্ড পর্যটক সমাগম ঘটেছে বলে জানিয়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ীরা জানান, টানা ছুটিতে ৬০০ কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা ছুটিতে জমজমাট হয়ে উঠে সব পর্যটন কেন্দ্রগুলো। পর্যটকেরা সমুদ্র সৈকত, দরিয়ানগর পর্যটনপল্লি, হিমছড়ি ঝর্ণা, ইনানী পাথুরে সৈকত, পাটোয়ারটেক, টেকনাফ জিরো পয়েন্ট সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক এবং মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরে ঘুরেছেন। এতে পর্যটকদের পদভারে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে সর্বত্র।
এদিকে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের সমাগম হলেও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন অঘটন ছাড়া বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। এতে দারুণ জমজমাট ব্যবসা করেছে পর্যটন ব্যবসায়ীরা। তবে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে পর্যটকদের।
সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, ঈদুল ফিতরের পরদিন থেকে আজ শনিবার পর্যন্ত কক্সবাজারে অন্তত সাত লাখ পর্যটক বেড়াতে এসেছেন। এছাড়া ২৬ মার্চ থেকে ঈদ পর্যন্তও বহু পর্যটক এসেছেন। সব মিলে ঈদুল ফিতরের ১১দিনের ছুটিতে প্রায় আট লাখ পর্যটকে সমাগম হয়েছে কক্সবাজারে। এতে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে পর্যটন ব্যবসায়ীরা। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পরিবহণ (যেখানে অন্তর্ভূক্ত বিমান, বাসা থেকে টমটম ও রিক্সাও) এবং বার্মিজ পণ্য, শুটকিসহ পর্যটকদের আকর্ষণীয় নানা সৌখিন পণ্যের প্রতিষ্ঠান এতে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে কলাতলীসহ পর্যটন জোনে পাঁচশতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস ও কটেজ রয়েছে। সেখানে দৈনিক প্রায় এক লাখ ২০ হাজার বেশি পর্যটক ধারণ-ক্ষমতা রয়েছে। আরো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পর্যটক বিভিন্নভাবে অবস্থান করেছে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিসংখ্যান মতে, গত ১১ দিনে গড়ে কম-বেশি মিলিয়ে প্রায় আট লাখ পর্যটক হোটেল-মোটেল ও কটেজে উঠেছে। অবশিষ্ট পর্যটকরা বিভিন্ন বাসা-বাড়ি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বাস ও তাবুতে রাত্রী যাপন করেছেন। অনেক পর্যটক দিনে এসে দিনে ফিরে গেছেন। আবার একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পর্যটক হোটেল কক্ষ না পেয়ে রাস্তা, সমুদ্র সৈকতে রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। সবমিলে এই ১১ দিনে প্রায় আট লাখের কাছাকাছি পর্যটক কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছেন।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিজন পর্যটকের দৈনিক গড়ে প্রায় সাত হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। এতে ঈদের পরের দিনগুলোতে দৈনিক প্রায় ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য মিলে সর্বমোট প্রায় ৬০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে।’
কক্সবাজার-হোটেল-মোটেল গেস্টহাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ‘এবারের ঈদের ছুটিটা ব্যতিক্রম হয়েছে। সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলে টানা ১১দিনের লম্বা এক ছুটি। ২৬ মার্চ থেকে এই ছুটি শুরু হলে ওইদিন থেকে কক্সবাজারে পর্যটক আগমণ হতে থাকে। তবে আগে ঈদের আগে হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মীয় বহু পর্যটক এসেছেন। ঈদের দিন থেকে সার্বিকভাবে সব শ্রেণীর পর্যটক এসেছেন। এতে শনিবার পর্যন্ত কলাতলী-হোটেল-মোটেল জোন ও মেরিন ড্রাইভ সড়কের সব হোটেল ও কটেজ শতভাগ কক্ষ বুকিং ছিলো। এতে সব স্তরের হোটেল ও কটেজে ভালো ব্যবসা হয়েছে।’ অগ্রিম বুকিং না দেয়ায় বহু পর্যটক কক্ষ নিতে পারেনি বলে জানান এই পর্যটন উদ্যোক্তা।
জেলা রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির সহ-সভাপতি কামরুল ইসলাম বলেন, ‘হোটেল-মোটেল জোন ও আশেপাশের এলাকায় প্রায় আড়াই’শ রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এই ঈদের ছুটিতে প্রতিদিন সব রেস্টুরেন্টে বেচাকেনা বেশ হয়েছে হয়েছে।
কক্সবাজার বীচপার্ক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, ‘বিপুল পর্যটক আসায় বার্মিজ পণ্য, কাপড়চোপড়, শুটকি, আচারের দোকানসহ পর্যটন এলাকার সব ধরণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেশ ভালো বেচাকেনা করেছে। এতে সবার মুখে হাসি ফুটেছে।’
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট ক্লাবের সভাপতি ও বিশিষ্ট পর্যটন উদ্যোক্তা এম. রেজাউল করিম বলেন, ‘অতীতে প্রতি মৌসুমে মার্চ পর্যন্ত সেন্টমার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করতো। এই মৌসুমে জানুয়ারিতে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয় সরকার। জাহাজ চালু থাকলে এই ঈদের ছুটিতে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আগ্রহী আরো বহু পর্যটক কক্সবাজারে বেড়াতে আসতো। এতে পর্যটন ব্যবসা আরো বেশ বাড়তো।’
তবে পর্যটক অভিযোগ করেছেন, বিপুল সংখ্যক পর্যটক আগমণকে পুঁজি করে হোটেল কক্ষ ও রেস্টুরেন্টে অতিরিক্ত দাম নেয়া হয়েছে। ২০০০ টাকার কক্ষ ৫০০০ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। একইভাবে বহু রেস্টুরেন্টে হাতিয়ে নিয়েছে দিগুণ দাম। রেকর্ড সংখ্যক পর্যটকের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের। সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নেয়া হয় কয়েক স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। তবুও ইভিটিজিং, ছিনতাইসহ কয়েকটি অঘটন ও দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সমুদ্র সৈকতে দোলনা ছিঁড়ে অন্তত ৩০ জন পর্যটক আহত হয়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার রিজিয়ন প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, ‘আগত সব পর্যটক প্রতিদিন প্রবেশ করেছে লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলীর পাঁচ কিলোমিটার সৈকতে। এত বিপুল সংখ্যক পর্যটকের চাপে হিমশিম খেতে হয়েছে। তারপরও আমাদের সদস্যরা নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি রাখেনি। রাতদিন সমানভাবে সমুদ্র সৈকত সর্বত্র নিরাপত্তার জোরদার করেছে। এতে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বড় কোনো অঘটন ঘটেনি।