একাধিকবার ব্যর্থ হওয়ার পর অবশেষে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে কিছুটা অগ্রগতি দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মিয়ানমার বাংলাদেশে আশ্রিত ৮ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজারকে ফেরত নেওয়ার জন্য 'যোগ্য' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এই সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অগ্রগতি হিসেবে দেখা হলেও রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারণ, রাখাইন রাজ্যের (আরাকান) প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মি’র নিয়ন্ত্রণে। সেখানে মিয়ানমার সরকারের প্রশাসনিক বা নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে।
রোহিঙ্গারা বলছেন, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের নিশ্চয়তা না থাকলে তারা ফিরতে চান না। তারা রাখাইনে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ‘সেইফ জোন’ (নিরাপদ অঞ্চল) গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বর্তমানে ১৪ লাখের বেশি। যাদের বেশিরভাগই ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান থেকে পালিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ সেই সময়ে মানবিক বিবেচনায় তাদের আশ্রয় দেয়, যা এখন দেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী সংকটে পরিণত হয়েছে।
রোহিঙ্গা মোহাম্মদ হোসেন বলেন, “স্বীকৃতি, নিরাপত্তা এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের নিশ্চয়তা ছাড়া ফেরার প্রশ্নই আসে না। রাখাইনে এখনো জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মির মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছে। আমাদের আত্মীয়রা এখনো নির্যাতনের শিকার।”
অন্য এক রোহিঙ্গা নেতা, মাওলানা আবদুল হামিদ বলেন, “আমরা দয়া নয়, অধিকার চাই। জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ যেখানে নেই, সেখানে আমাদের পাঠানোর আলোচনা কেবল প্রহসন হতে পারে।”
রোহিঙ্গা কমিউনিটি মনে করছে, আরাকান আর্মিও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। বরং অনেক জায়গায় তারাও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
কুতুপালংয়ের আব্দুল আজিজ বলেন, “মিয়ানমারের জান্তার অস্তিত্বই নেই রাখাইনে। তাহলে তারা কোথায় রোহিঙ্গাদের রাখবে? এটা কেবল একটি রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা।”
রোহিঙ্গা নেতারা আরও বলেন, আগে রাখাইনে পরিদর্শনে যাওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দল নিরাপত্তার অভাব দেখে প্রত্যাবাসনে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এবারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা নিয়েও তারা সন্দিহান।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, “বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। যেসব জায়গায় রোহিঙ্গাদের রাখা হবে বলে বলা হচ্ছে, সেসবই এখন আরাকান আর্মির দখলে।”
রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, “মিয়ানমার ৮ লাখের তালিকা থেকে ১ লাখ ৮০ হাজারকে গ্রহণে সম্মত হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে রাখাইনে তাদের রাখার অবস্থা নেই। এমনকি জান্তা সরকার নির্বাচনের তারিখ দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।”
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার আবু সালেহ মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ বলেন, “আমরা প্রস্তুত আছি। তালিকা হাতে পাওয়ার পর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু হবে।”
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী মনে করেন, “এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কূটনৈতিক সাফল্য। তবে মিয়ানমারকে এখন স্পষ্ট করে জানাতে হবে, রোহিঙ্গাদের কোথায় এবং কীভাবে রাখা হবে।”
আবা/এসএস