দেশের অন্যতম সামুদ্রিক শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক। এখানকার ৭০০ শুঁটকি মহালে প্রতিবছর অন্তত ৪০০ কোটি টাকার সামুদ্রিক মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। পাশাপাশি জেলার সমুদ্র উপকূলের আরও দুই শতাধিক মহাল মিলে ৯০০ মহালে প্রতিবছর ৬০০ কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদন হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব মহালে ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক ও মৎস্যজীবী জড়িত রয়েছেন। এ ছাড়া উপকূলের বিভিন্ন বাসাবাড়ির ছাদ ও উঠানে মাচা বেঁধেও মাছ রোদে শুকানো হয়।
এসব শুঁটকি কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটক ও স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। প্রতিবছর নয়মাস এই মহালে শুটকি উৎপাদন হলেও এ বছর সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা এগিয়ে আনায় গতকাল মঙ্গলবার(১৫ এপ্রিল) থেকে উৎপাদন বন্ধ করতে হয়েছে। সামুদ্রিক মাছের প্রজনন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার এবার একমাসে ৫ দিন আগে মাছ ধরায় ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে নাজিরারটেক ছাড়াও জেলার অন্যান্য মহালেও বন্ধ হবে শুটকি উৎপাদন। এতে এ বছর শতকোটি টাকার শুটকি উৎপাদন কম হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান জানিয়েছেন, ভারত সরকার প্রতিবছর ১৫ এপ্রিল থেকে ৬০ দিন তাদের সাগরে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে। এ সময় ও পরের সময় বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় নিষেধাজ্ঞা না থাকায় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশি জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরে নিয়ে যান। এ কারণে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই সময়সীমা এগিয়ে এনে ভারতের সঙ্গে মিল রেখে ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, কক্সবাজারের সামুদ্রিক শুঁটকি মাছের মৌসুম শেষের দিকে হলেও আরো পুরো একমাস হাতে রয়েছে। কিন্তু সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় পরিবর্তন হওয়ায় এবার শুঁটকি উৎপাদন মৌসুম শেষ হচ্ছে এক মাস আগেই। প্রতিবছর ৯ মাস শুঁটকি উৎপাদন করা গেলেও এবার থেকে সেই সময় কমিয়ে আট মাস করা হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত আট মাসে দেশের বৃহত্তম নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সোনাদিয়া, সেন্ট মার্টিন, টেকনাফসহ অন্যান্য এলাকায় মিলে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার বেশি শুটকি উৎপাদন হয়েছে। নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমিতির সাবেক সভাপতি আতিকুল্লাহ কোম্পানি জানান, প্রতিবছর ভাদ্র থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত ৯ মাস শুঁটকি উৎপাদন হয়। দীর্ঘকাল ধরে এই নিয়ম চালু রয়েছে। কিন্তু চলতি মৌসুম থেকে একমাস আগেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে উৎপাদন কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার কমে যাবে। পুরো সময় পেলে শুঁটকির উৎপাদন দাঁড়াত কমপক্ষে ৬০০ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, ‘নাজিরারটেক এলাকার অন্তত ৪০০ একর বালুচরজুড়ে বসে শুঁটকি মৌসুমের এক মহাযজ্ঞ। এখানে রয়েছে প্রায় ৭০০টি শুঁটকি শুকানোর মাচা (মহাল)। এ ছাড়া জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সোনাদিয়া, সেন্ট মার্টিন, টেকনাফসহ অন্যান্য এলাকায় আরো দুই শতাধিকসহ ৯ শতাধিক মাচায় দৈনিক কমপক্ষে ১৬০ টন শুঁটকি উৎপন্ন হয়ে থাকে। এবার একমাস সময় কম হওয়ায় উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমিতি তথ্য মতে, কক্সবাজার পৌরসভার ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৮টি গ্রামের মানুষ বেশির ভাগই নাজিরারটেক শুঁটকি মহালের সঙ্গে জড়িত। এতে ৩০ হাজার নারী শ্রমিকসহ রয়েছে কমপক্ষে ৪০ হাজার শ্রমিক। কক্সবাজার উপকূলে ৭ হাজার মাছ ধরার ট্রলারে অন্তত এক লাখ জেলে রয়েছে। এই শুঁটকি মহাল থেকেই সারাদেশে প্রতি সপ্তাহে ২৫ থেকে ৩০ ট্রাক করে শুঁটকি সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি ট্রাকে থাকে ১২-১৩ টন করে শুঁটকি যায় বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪২ হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে শুঁটকি উৎপাদন হয়েছিল ৩১ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন। একমাস সময় কমলেও আবহাওয়া অনুকূল থাকায় এবারও ৩৮ থেকে ৪০ হাজার মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপন্ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।