স্বস্তি নেই কোনো পণ্যে, ক্রেতাদের নাভিশ্বাস
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৪৫ | অনলাইন সংস্করণ
অনলাইন সংস্করণ
বাজারে কোনো পণ্য কিনতে গিয়েই স্বস্তি পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। প্রতিটি পণ্যের দামই হু হু করে বাড়ছে। মধ্যবিত্তরাও এখন দামের চাপে ব্যাগের তলানিতে পণ্য নিয়ে ফিরছেন ঘরে।
বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, নিউমার্কেট, শান্তিনগর ও হাতিরপুল বাজার ঘুরে এবং নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে তাদের কষ্টের কথা। সাধ আর সাধ্যের ফারাকের কথা। কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, সাধারণ মানের চালের দাম কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা বেড়েছে।
কয়েকদিন আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, যেখানে প্রতি কেজি চালের দাম ৫০ পয়সা বাড়ার কথা, সেখানে ব্যবসায়ীরা ৪ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, বাজারের চিত্র আরও ভিন্ন। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চালের দাম ৩-৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আজ মোটা চালের মধ্যে আটাশ চাল মান ভেদে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫৮-৬০ টাকায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আগে এ চাল বিক্রি হতো ৪৫-৪৬ টাকায়। প্রতি কেজি নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮২ টাকায়, যা আগে ছিল ৭৫-৭৮ টাকা। প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ৭২-৭৫ টাকা, আগে ছিল ৬৮-৭০ টাকা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাভাব, বাজার মনিটরিংয়ের অভাব, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটসহ নানাবিধ কারণে বাজারে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে, পণ্যের দাম কী পরিমাণে বাড়া উচিত এবং কী পরিমাণে বেড়েছে, এ খবর রাখতে কোনো সংস্থাকেই মাঠে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে, যে যার মতো পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। এতে সব শ্রেণির ক্রেতারা পড়ছেন ভোগান্তিতে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরি বলেছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি মানে এই নয় যে, ব্যবসায়ীরা যা খুশি তা-ই করার সুযোগ পাবে। বিশ্বের অনেক দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকলেও তার নিয়ন্ত্রণ থাকে সরকারের হাতে। বাংলাদেশেও এ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সরকারের হাতে রাখতে হবে। এজন্য দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
কারওয়ান বাজারের নোয়াখালী রাইস এজেন্সির মালিক আব্দুল মতিন বলেন, মিলাররা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে অনেক আগে থেকেই চালের দাম বাড়িয়েছে। সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৪-৬ টাকা বাড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর যেখানে কেজিপ্রতি ৫০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১ টাকা বাড়ার কথা, তখন এসব মিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা মিলে সিন্ডিকেট করে প্রতি কেজি চালে আবারও ৫-৭টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে, খুচরা বাজারে চালের দামে প্রভাব পড়েছে।
এদিকে, খুচরা বাজারে আজ প্রতি কেজি মসুর ডাল ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহেও ছিল ১২০-১২৪ টাকা। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৯০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা ছিল ১৮৫-১৯০ টাকা। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৩৫-৪০ টাকা ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৪৫ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ৪০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৩০-৩৫০ টাকায়, যার দাম ছিল ৩০০-৩২০ টাকা। তেলাপিয়া প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়, যা ছিল ১৬০-১৮০ টাকা। কই মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৮০-২০০ টাকা।
বেকারি পণ্য পাউরুটি, বিস্কুট, চানাচুর, নুডলসসহ নাশতার আইটেমের দাম বেড়েছে ১০-৩০ টাকা পর্যন্ত। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ঘুরে এবং বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় আকারের পাউরুটি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়, যা আগে ৮০-৮৫ টাকা ছিল। ৩০০ গ্রাম ওজনের প্যাকেট চানাচুর বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়, যা ছিল ৭৫ টাকা। ৮ পিসের প্যাকেট নুডলস বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়, যার দাম ছিল ১৪০ টাকা। এনার্জি বিস্কুটের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়, যা ছিল ৩৮ টাকা। ১০টাকা বেড়ে পাইনঅ্যাপল বিস্কুটের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। প্রতি কেজি টোস্ট বিস্কুট বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়, যার দাম ছিলো ১৪০ টাকা। প্রতি লিটার কোকের দাম ৫টাকা বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে। ৬০০ মিলি ওজনের প্রাণ সসের বোতল ৭৫ টাকা, যার দাম ছিল ৬২ টাকা।
হাতিরপুলের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে আসা সোহাগ হোসেন বলেন, বাজারে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই। দাম বাড়ার কারণে অল্প অল্প করে কিনছি। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।
আরেক ক্রেতা শফিকুল বলেন, শুধু নিত্যপণ্যের দামই বাড়েনি। বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে পানি ও বিদ্যুৎ বিল সবকিছুই বেড়েছে। বাসভাড়া বেড়েছে। বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানো হয়, কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে দাম কমলে একবার বেড়ে যাওয়া জিনিসের দাম আমাদের এখানে আর কমে না।
ওষুধ কিনতে আসা সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা নাজমা বেগম বলেন, প্রায় সব ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে। নাপা সিরাপের দাম ২০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫ টাকা হয়েছে। অ্যান্ট্রাজল ড্রপ ১০ টাকা ছিলো, এখন ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২৪ টাকার অ্যামোক্সিসিলিন ইনজেকশন ৫৫ টাকা, ২১ টাকার প্রমেথাজিন ৩৫ টাকা হয়েছে। জিনিসপত্রের পাশাপাশি ওষুধের দাম যেভাবে বাড়ছে, জীবন রক্ষা করাই তো কষ্টকর হয়ে পড়ছে।
শীতের মওসুম বলে বাজারে সবজির চাহিদা রয়েছে। দাম চড়া। সিম প্রতি কেজি ৪০-৫০ টাকা, টমেটো প্রতি কেজি ৫০-৬০ টাকা, ফুলকপি প্রতিটি ২৫-৩০ টাকা, লাউ প্রতিটি ৫০-৬০ টাকা। বেগুন (গোল) প্রতি কেজি ৬০ টাকা, লম্বা বেগুন ৫৫ টাকা, নতুন আলু কেজি ৩০-৩৫ টাকা। মরিচ কেজি ৯০-১০০ টাকা।
বাজারে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিসহ সার্বিক বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ব্যবসায়ীদের আরও বেশি করে সচেতন হতে হবে। তারা অবশ্যই ব্যবসা করবেন, তবে সেটা যৌক্তিকভাবে। কিন্তু, আমাদের এই চাওয়াটা তারা মানছেন না। এ ব্যাপারে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের অভিযান টিম প্রতিনিয়ত বাজার তদারকি করছে।