আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস

ইসলামে বিধবাদের অনুপম অধিকার

ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২০, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিদায়ী জুন মাসের শেষ সপ্তাহে ছিল আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘দ্য লোম্বা ফাউন্ডেশন’ এর প্রস্তাবনায় ২০১০ সালে জাতিসংঘে পাস হওয়া এই দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে গত ১০ বছর ধরে। সারা বিশ্বের বিধবাদের সম্মান-মর্যাদা এবং অধিকার সুরক্ষা ও নিশ্চিত করার জন্য এ দিবসটি বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়। অবশ্য ইসলাম বিধবাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে ১৪০০ বছর আগে।

দ্য লোম্বা ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য মতে, বর্তমান বিশ্বে প্রায় ২৫৮ মিলিয়ন বিধবা রয়েছে। তাছাড়া কোভিড-১৯ এর কারণে আরও আনুমানিক প্রায় ১ লাখ নারীকে বিধবা হতে হয়েছে। এসব বিধবাকে প্রায় সবারই অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তাছাড়া কোভিড-১৯ মহামারি মানব সভ্যতাকে বিভিন্নভাবে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

তন্মধ্যে অর্থনৈতিক সমস্যা অন্যতম হিসেবে এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে। ফলে এর কুপ্রভাব পড়বে ওইসব বিধবার জীবনেও, যারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নয়। তাই, অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বৈশ্বিক এই পরিস্থিতিতে বিধবাদের প্রতি আমাদের দায়িত্বানুভূতি আরও বেশি জোরদার করতে হবে বলে সংস্থাটি তাগিদ দিচ্ছে। জাতিসংঘও এই দিবসটিকে সামনে রেখে প্রত্যেক দেশের সরকারকে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সহায়তা প্রত্যাশী বিধবাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য ঘোষণা করেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের বাংলাদেশ সরকার অনেকাংশে এগিয়ে রয়েছে। ১৯৯৮-১৯৯৯ অর্থবছর থেকে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা চালু, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, ক্ষমতায়নসহ আরও বিশেষ কিছু পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এক তথ্য মতে, যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে প্রায় ২৪ শতাংশ বিধবা বৃদ্ধি পেয়েছে গত কয়েক বছরে। তবে, সবচেয়ে বেশি বিধবা রয়েছে গণচীনে এবং ভারতে। আর এসব বিধবার সঙ্গে রয়েছে তাদের সন্তানরা। ফলে, বিশাল এক জনগোষ্ঠী পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে এবং ব্যাহত হচ্ছে তাদের সাধারণ জীবন ব্যবস্থা। এ পরিস্থিতির সত্যিই পরিত্রাণ দরকার। উল্লেখ্য, মুসলিম বিশ্বে বিধবার হার তুলনামূলক কম।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রাচীন ও বর্তমান অনেক ধর্ম ও সমাজব্যবস্থায় বিধবাদের জীবন অত্যন্ত মানবেতর। শুধু বিধবা হওয়ার কারণে ধর্ম ও সংস্কৃতির কারণে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি তাদের হতে হয়, যা বর্ণনা করা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ হিন্দু ধর্মের সতীদাহ প্রথার কথা উল্লেখ করা যায়। এ প্রথা বিলোপ হলেও সে সমাজে এখনও রয়েছে নানাবিধ কুসংস্কার, যা একজন বিধবাকে নিগৃহীত করে, অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। কিছু মুসলিম সমাজেও বিধবাদের প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া হয় না। ফলে বিধবা পরবর্তী জীবন আর স্বাভাবিক হয়ে উঠে না। মূলত ধর্মকে না বোঝার কারণে এমনটি হয়ে থাকে।

সত্যিকার অর্থে বিধবাদের সঙ্গে প্রাচীন সব কুসংস্কারকে উপড়ে ফেলে সত্যিকারের সম্মান-মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম। ইসলামের সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজে বিধবাদের বিবাহের মাধ্যমে, তাঁর সাহাবিদের বিধবা বিয়ে করার নির্দেশ দিয়ে এবং তাদের সব সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিশ্ববাসীর কাছে।

বিধবাপরবর্তী নারীকে সামাজিক মর্যাদা এবং নিরাপত্তার জন্য পরবর্তী বিবাহের কোনো বিকল্প নেই। যা ইসলাম অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছে। কোরআন ঘোষণা করছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মৃত্যুবরণ করবে, তাদের স্ত্রীদের কর্তব্য হলো চার মাস ১০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা। এরপর যখন ইদ্দত পূর্ণ করে নেবে তখন তারা নিজেদের ব্যাপারে বিধিমতো ব্যবস্থা নিলে তাতে কোনো পাপ নেই। ...’ (সূরা বাকারা : ২৩৪) বিবাহোত্তর স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের পোশাক হিসেবে তুলনা করা হয়েছে। সেখানে বিধবা, কুমারী, তালাকপ্রাপ্তাকে পার্থক্য করা হয়নি। বিবাহ বা সামাজিক কোনো ক্ষেত্রেই বিধাব-সধবা বা কুমারী নারীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নিরূপণ তো করেইনি, বরং বিধবাদের বিবাহ করা এবং তাদের সঙ্গের এতিম সন্তানদের নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিত করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যম্ভাবী করে দিয়েছে। বিবাহক্ষম নারীদের দায়িত্ব নিতে উৎসাহ প্রদান করে রাসুল (সা.) ঘোষণা করেন, ‘যারা বিধবা নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়, তারা যেন আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং নিরলস নামাজি ও সদা রোজা পালনকারী।’ (বোখারি ও মুসলিম)

যেখানে, নারীরা কোনো সম্পত্তিরই মালিক হতে পারত না, বরং নিজেরাই পণ্য হিসেবে বিক্রি হতো সেখানে স্বামীর মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে বিধবা স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলাম।

সেক্ষেত্রে কোনো সন্তান থাকলে স্ত্রী এক অষ্টমাংশ এবং না থাকলে এক-চতুর্থাংশ সম্পত্তির মালিক হবেন। কারণ, সন্তান থাকলে তারা শুধু বাবার সম্পত্তিতে ভাগ বসিয়ে মাকে ক্ষতির মধ্যে ফেলবে এমনটি নয়, বরং সন্তানকে (বালেগ হলে) তার মায়ের সব দায়িত্বও নিতে হবে। এটি ইসলামে বাধ্যতামূলক।

ফলে, ইসলাম বিধবাদের জন্য যেসব দায়-দায়িত্ব আমাদের ওপর ন্যস্ত করেছে, তা যদি যথাযথভাবে আমরা পালন করতে পারি, তাহলে আর কোনো বিধবা অপমানিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত হবে না। অনাহারে, অনাদরেও আর কাউকে জীবনযাপন করতে হবে না, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। বিধবাদের প্রতি সত্যিই আমরা দায়িত্ববান হয়ে উঠি, এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

 

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক