দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পরে ফিরে আসে মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। তবে ঈদ শুধু ধর্মীয় উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় এটি মুসলমানদের কাছে সাংস্কৃতিক উৎসবের উপলক্ষ্যও বটে। প্রতিবছর ঈদ এলেই সকলে আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠে। প্রিয়জন ছেড়ে দূরে থাকা মানুষজন উন্মুখ হয়ে ওঠে প্রিয়জনের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। তাদের এই প্রস্তুতি শুরু হয় রমজানের শুরু থেকেই। তাইতো তারা নাড়ির টানে ছুটে যায় আপন ঠিকানায়।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে ঈদের আনন্দটা একটু ব্যতিক্রম। নিজ পরিবার ছেড়ে বছরের অধিকাংশ সময় তাদের ক্যাম্পাসেই কাটে। পড়াশোনা, এসাইনমেন্ট, মিডটার্ম, ল্যাব, প্রেজেন্টেশন ও সেমিস্টার পরীক্ষার ব্যস্ততার মধ্যেই তাদের সময় কেটে যায়। এতোসব ব্যস্ততায় বাড়িতে নিজ পরিবারের কাছে ছুটে যাওয়া যেন স্বপ্ন শিক্ষার্থীদের। তাদের কাছে ঈদের ছুটির সময়টাই যেন মহান কিছু পাওয়া। ছুটির অনেক পূর্ব থেকেই শুরু হয় তাদের পরিবারের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি।
টিউশনির দীর্ঘশ্বাস থেকে মুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন পরে মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয় তাদের। রমজানে মা-বাবার সাথে ইফতার ও সাহরি করার স্বর্গীয় তৃপ্তি লাভ করেন। বাড়িতে শৈশবের বন্ধুবান্ধবদের সাথে ছোটবেলার আনন্দ আরেকবার ভাগাভাগি করে নেয় শিক্ষার্থীরা। এ যেন ঈদের আগেই আরেক ঈদের আনন্দ। কখনো কখনো এই আনন্দ ঈদের আনন্দকেও ছাপিয়ে যায়।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ল’ অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী রবিউল আলমের বাড়ি কক্সবাজার। বাড়িতে যান শুধুমাত্র দুই ঈদের ছুটিতে। তাই বাড়ি যাওয়ার আনন্দ প্রকাশ করে রবিউল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় আর বাড়ির দূরত্ব বেশি হওয়ায় দুই ইদের ছুটির দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে রই কবে ইদের ছুটি আসে। অন্যান্য ছুটির চেয়ে ইদের ছুটি দীর্ঘ হওয়ায় এমনটা হয়ে থাকে। আমার কাছে বাড়ি ফেরা মানে বছরের ২ বার। আম্মু আব্বু বলে না কখন আসবা! ইদের ছুটির এক মাস আগে থেকেই প্রহর গুনতে থাকে আম্মু। কোনো কারণে রমজানে ১ দিনেও থাকতে হয় তাহলে সকাল বিকাল কৈফিয়ত দেওয়া লাগে। আমার কাছে ছুটি মানেই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ে মায়ের অশ্রুসিক্ত টলমল চোখ আর বাড়ি ফেরার পর কপালে চুমু খাওয়া।’
তবে অন্যান্যদের চেয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াসিন কাজীর ঈদ আনন্দ একটু ব্যতিক্রম। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় মা হারিয়েছেন তিনি। তাই ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য আগের মতো এখন আর কেউ তাকে জোরাজুরি করে না। ইয়াসিন বলেন, ‘দীর্ঘ অপেক্ষার পর পরিবারের সাথে আনন্দঘন মুহূর্ত কাটানোর সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারটা প্রকাশ করার মত নয়। রমজান মাস শুরু হতে না হতেই পরিবারের কাছে যাওয়ার দিনক্ষণ গণনা শুরু হলেও তার পূর্ণতা পায় রমজানের শেষ দশকে। ক্যাম্পাসে বন্ধুবান্ধব, সিনিয়র, জুনিয়রের সাথে দীর্ঘ সময় সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে অতিবাহিত করলেও পরিবারের কাছে এসে সেগুলো গল্প আকারে প্রকাশ করার অনুভূতি সম্পূর্ণই আলাদা। তবে পরিবারের মধ্যে যদি মায়ের অনুপস্থিতি থাকে তাহলে আনন্দের পরিবর্তে কেমন রূপ নিতে পারে সেটা আমি বলে বুঝাতে পারবো না। প্রতিবছরের ন্যায় এই বছরও বাবা, ভাই, বোন ক্যাম্পাস ছুটির খোঁজ খবর নিতে কমতি না রাখলেও মা আর খোঁজ নিচ্ছেন না। এখন আর বলে না বাবা ছুটি হবে কবে, জোরাজোরি করছে না তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়। গত বছরও রমজান মাসের ঠিক এমন সময়ে সবাই একসাথে সাহরি, ইফতার করেছি। কিন্তু এখন শুধু একজনের অনুপস্থিতি। সকলের ইদ আনন্দের হয়না, কারো ইদ মনে কষ্ট নিয়ে আনন্দ বলে চালিয়ে দিতে হয়।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ল’ অ্যান্ড জাস্টিস বিভাগের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফিরছি এটা ভাবতেই মন ভরে যাচ্ছে আনন্দে। সারাবছর ক্যাম্পাসের ব্যস্ততায় পরিবারের সঙ্গে কাটানোর সময় খুব কম পাই। কিন্তু ঈদ মানেই তো প্রিয়জনদের কাছে ফেরা, শৈশবের স্মৃতিগুলো নতুন করে উপভোগ করা। মায়ের হাতের খাবার, বাবা-ভাইবোনদের সঙ্গে ঈদের সকাল, ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি এসবের জন্য মন কবে থেকেই ব্যাকুল ছিল। এবার ঈদে বাড়ি ফিরে সেই আনন্দগুলো আবার উপভোগ করতে পারব ভাবতেই দারুণ লাগছে।’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘ঈদের আনন্দ মানেই অন্য সকল আনন্দের চেয়ে একটু অন্যরকম আনন্দ। দীর্ঘ একমাস রোজা রাখার পরে আমাদের কাছে ঈদ আসে। ক্যাম্পাস ছেড়ে মায়ের হাতের রান্না খাওয়া, ইফতারিতে সকলে একসাথে বসা এর আনন্দ বলে বুঝানো যায় না। তাছাড়া ২০ রমজানের পরেই শুরু হয় ঈদের জন্য নতুন কিছু কেনার ধুম। ইদের দিন সকল বন্ধু, আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাওয়া। এ সকল আনন্দ অন্যান্য ছুটির সময়ের চেয়ে একটু বেশিই।’