সঙ্গীতশিল্পী রেহানা সিদ্দিকী
প্রকাশ : ০৮ জুন ২০২৩, ১৮:৩২ | অনলাইন সংস্করণ
আধুনিক ও নজরুলগীতির সঙ্গীতশিল্পী রেহানা সিদ্দিকী তাঁর স্বামী বুরহান সিদ্দিকীর মৃত্যুর পর এই প্রথম গণমাধ্যমে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন। স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে তাঁর আবেগময় কিছু স্মৃতি চারণ এখানে সংযুক্ত করা হল। মরহুম বুরহান সিদ্দিকী বাংলাদেশ পুলিশের আইজি ছিলেন। তিনি নামিবিয়া ও আবুধাবি রাষ্ট্রদূত ছিলেন। অন্যদিকে তিনিও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। গানের প্রতি দুজনের প্রচণ্ড ভালোবাসা। দুজনে দুইজনকে বেঁধে নিয়েছিলেন একই গান-মালা সুতোয়। অন্যদিকে তিনি ছিলেন সঙ্গীতের প্রতি প্রচণ্ড অনুরাগী একজন মানুষ। ঠিক একই ধারায় রেহানা সিদ্দিকী স্বামীর পাশে থেকে সর্বতভাবে সহযোগিতা করতেন। তাঁরা দুইজনে আসলে একই আত্মার মানুষ ছিলেন। এই সফল দম্পতির পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সকলের জন্য শিক্ষামূলক একটি বিষয়। করোনার সময়ে জনাব বুরহান সিদ্দকী মৃত্যুবরণ করেন। এক বিকেলে রেহানা সিদ্দিকীর বাসায় বসে কথা বলছিলাম আমরা।
রেহানা সিদ্দিকী ৮০ সালে আমাদের সঙ্গীতের স্বনামধন্য সকল সঙ্গীত শিল্পীর সাথে ডুয়েট গান করেছেন। এদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী, আবদুল জাব্বার, সুবীর নন্দী, বুরহান সিদ্দিকী উল্লেখযোগ্য। তিনি মূলত আধুনিক গানের শিল্পী। তাঁর জনপ্রিয় গান সমুহের মধ্যে আছে– আজ সন্ধ্যা আকাশের নীল কপালের, আমি আধার দেখে ভয় পেয়ে ভাই, মাগো কণ্ঠে তোমার ৩০ লক্ষ দুলছে ফুলের মালা, শেষ বিকেলে যখন আমায় সুরে সুরে (দ্বৈত কণ্ঠ বুরহান সিদ্দিকী), রাতের প্রশান্ত মোহাসাগরে ভেসে চলেছি দ্বৈত কণ্ঠ বুরহান সিদ্দিকী), পথ চলতে চলতে কথা বলতে বলতে, মেঘ দূত নেই শুধু, চাঁদ সুন্দর আলো আছে তাই (দ্বৈত কণ্ঠ সুবীর নন্দী), আধখানা চাঁদ হাসিছে আকাশে সহ অনেক স্রুতিমধুর গান।
বিশিষ্ট সমাজসেবী, নারী কল্যাণে নিবাদত ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশের অন্যতম জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, দক্ষিন এশিয়া আঞ্চলিক সহযােগিতা সংস্থা (SAARC) এর নারী এডভোকেসি গ্রুপ (SAWAG) এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি এবং জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রেহানা সিদ্দিকীর পৈত্রিক নিবাস চট্টগ্রাম জেলার মিরেরসরাই উপজেলার ইছাখালি ইউনিয়নস্থ সাহেবদিনগর গ্রামে। তাঁর পিতামহ বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মরহুম মাওলানা জহুরুল হক কোলকাতা সরকারী ইসলামী মাদ্রাসা হতে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে নিজ গ্রামের মাদ্রাসায় ইসলামী শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হন। রেহানা সিদ্দিকীর পিতা জনাব মো: নুরুল আনোয়ার একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা। তাঁর বয়স ৯৮ বছর। অবসর গ্রহনের আগে তিন সরকারের যুগ্ম সচিব এবং দূর্নীতি দমন ব্যৃরোর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রীধারী রেহানা সিদ্দিকী বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় এর নারী উনয়ন মনিটরিং কমিটির সদস্য। এছাড়াও তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নারী পাচার বিরােধী কমিটির সদস্য এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্যানিটেশন সম্পর্কিত জাতীয় টাস্ক ফোর্স এর সদস্য।
স্বামী বুরহান সিদ্দিকী সম্পর্কে রেহানা সিদ্দিকী বলেন, আমি সবসময় উনাকে স্মরণ করি। আমার কাছে উনি যে কি ছিলেন তা আপনাকে আমি ঠিকভাবে বুঝাতে পারব না। তিনি তো শুধুমাত্র আমার একজন স্বামী ছিলেন না। তিনি ছিলেন আমার চলার পথের একজন আন্তরিক সহযাত্রী, আত্মার বন্ধু। স্মরণীয় ঘটনা বলতে আসলে তাঁর সাথে কাটানো প্রতিদিনকেই আমি স্মরণীয় মনে করি। তিনি ছিলেন প্রতিটি পদক্ষেপেই স্মরণ করার মত এমন একজন ব্যক্তিত্ব। যাকে এক মুহূর্ত এই অন্তর থেকে সরিয়ে রাখা অসম্ভব। যেকোনো কার্যক্রমে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছি দুজনের নিজস্ব মতামত গুলো পরস্পর শেয়ার করে। সে কারণেই তিনি আমাকে একটি দুশ্চিন্তা মুক্ত জীবন উপহার দিতে পেরেছেন। এই মুহূর্তেও আমি সম্পূর্ণ চিন্তা মুক্ত জীবনে আছি। নিশ্চিন্তভাবে দিন কাটাচ্ছি। শুধুমাত্র তিনি সামনে নাই।
সঙ্গীত জীবনের শুরুর দিকের বিষয়ে রেহানা সিদ্দিকী বলেন, আপনি তো জানেন আমার সঙ্গীত জীবনটা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় নি। আমার মা খালারা গান করতেন। আমদের ঘরে হারমোনিয়াম ছিল। এরপর কখন যে হারমোনিয়াম বাজানো শিখে গেলাম আমি এখন তা বলতে পারব না। একেবারে ছোটবেলা থেকেই নিজে নিজে গান গাইতে শুরু করছি। একটু যখন বড় হলাম তখন আমার বাবা মা আমার গান শেখার দিকে একটু নজর দিলেন। হয়ত তাঁরা আমার ভিতর কিছু দেখেছিলান। আমার বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। ফলে জেলা থেকে জেলায় বদলির চাকুরী ছিল। এবং বিভিন্ন জেলায় কয়েকজন ওস্তাদের কাছে গান শিখেছিলাম। আমাদের ছোটবেলায় রেডিওতে শিশুমেলা নামে একটি অনুষ্ঠান হত। যতদূর মনে পড়ে সাহিত্যিক নুরুন নাহার ফয়জুন্নেসা এটা পরিচালনা করতেন। সেই অনুষ্ঠানে গান কবিতা ছড়া করতাম। এরপর একটু বড় হলে ১৯৭২/৭৩ সালে রেডিওতে বড়দের অনুষ্ঠানের অংশ নিতাম। মূলত আমার বাবা মা এর উৎসাহে আমি রেডিও টিভি তে অনুষ্ঠান করি। আর এদেশে টিভির শুরুর প্রথম থেকেই আমি গান গাইতে শুরু করেছিলাম। আব্বা তখন ঢাকা ছিলেন এবং আমি যখন ছায়ানটে গান শেখার সুযোগ পাই তখন টিভির যাত্রা শুরু। এরপর আমার বিয়ে হলে আমার স্বামীকেও গানের প্রতি অনুরাগ দেখলাম। উনার সাথে অনেক দ্বৈতসঙ্গীত গেয়েছি। এছাড়া আমাদের সময়ে সকল বিখ্যাত শিল্পীদের সাথে আমার গান আছে। আমি মূলত আধুনিক গানের শিল্পী। এছাড়া রবীন্দ্র নজরুল ও পঞ্চকবির গান করেছি।
সমাজ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর ভাবনা চিন্তা জানতে চাইলে বলেন রেহানা সিদ্দিকী বলেন, আমি ভেবে দেখেছি, সৃষ্টিকর্তা আমাদের কল্যাণে আমাদের মঙ্গলের জন্য আমাদের উপভোগের জন্য তার এই প্রকৃতিতে কত কিছুই না সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তিনি উজাড় করে দিয়েছেন তার সম্পদের ভান্ডার হতে অসংখ্য মূল্যবান প্রাকৃতিক উপাদান। কিন্তু তা কি শুধুমাত্র এই প্রাণীকুলের মানব সন্তানদের জন্য? এই সম্পদের ভান্ডার কি শুধু মনুষ্য সমাজের ভোগ করার অধিকার? সৃষ্টিকর্তা আরও অসংখ্য প্রজাতির জীবজন্তু পশুপাখি সৃষ্টি করেছেন। তাদের কি স্বাধীনভাবে ভোগ করার কোনোই অধিকার নেই? আমাদের লোভাতুর চরিত্র প্রকৃতির মহামূল্যবান সম্পদ মাটি, পানি, বাতাস, গাছপালার প্রতি যত্নশীল না হয়ে বরং ধ্বংস করে দিচ্ছি এদের বংশবিস্তার। দূষিত করে চলেছি এই পৃথিবীর বাসযোগ্য পরিবেশ। নিধন করেছি গাছপালা। এমনকি আমাদের নিজ শরীরটিকেও নানা অনিয়মের মাধ্যমে অত্যাচার নির্যাতন হতে রেহায় দিচ্ছি না। আমরা তো প্রানী হিসেবে প্রকৃতির একটি অংশ মাত্র। এসব কিছুর উপর শুধুমাত্র আমাদের একার অধিকার থাকতে পারে না। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত প্রতিটি প্রাণীর উপর অত্যাচার অবিচার ও নিপীড়নের মাধ্যমে মহা পাপে লিপ্ত হয়েছে। প্রকৃতির প্রতি আমরা আরো ভালোবাসা দেখিয়ে, যত্নবান ও মনোযোগী হয়ে যে পুণ্য সঞ্চয় করতে পারি সেই বিষয়টিও আমরা সামান্যতম অনুভব করছিনা। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত জীবনধারার উপায়গুলি যদি আমরা সঠিকভাবে মেনে চলতাম, তাহলেই বোধ করি আমাদের জীবনকে আমরা পরিপূর্ণভাবে ভোগ করে যেতে পারতাম। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে অসংখ্য বিচিত্র প্রাণীকুল রয়েছে, শত বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও তারা নিজ নিজ স্বকীয়তা বজায় রেখে একইভাবে একই ঐকতানে নিজস্ব অধিকার ভোগ করবে সেটাই হবে সঠিক প্রকৃতি নিয়ম। নিয়মের ব্যতিক্রম হলে আমরা আমাদের জীবন সর্বনাশ থেকে আনবো। সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থাই দিতে পারে আমাদেরকে একটি সুস্থ পারিবারিক। সামাজিক রাষ্ট্রীয় এবং সমপরি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও ঐক্যের পরিবেশ। পরিশেষে বলা যায় আমাদের যার যা ধর্ম, আদর্শ ও বিশ্বাসগুলোর উপর আস্থা রেখে– নিজস্ব পরিমিত বোধশক্তি, বিবেক সততা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে এ জীবনকে করে তোলা একটি সুখময় তৃপ্তিময় দুশ্চিন্তা মুক্ত শান্তির জীবন। আর এভাবেই হয়তোবা মিলতে পারে এই পার্থিব জীবনের সকল লোভ লালসা মোহ ও অস্বাভাবিক প্রাচুর্যের আকর্ষণ হতে সম্পূর্ণভাবে- আমার মুক্তি। –শফি দিদার