ঢাকা ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পৌষ পাবণের উৎসবে মাতোয়ারা গবি

পৌষ পাবণের উৎসবে মাতোয়ারা গবি

পিঠা বাঙালি সমাজে এক অনন্য উপাদানের নাম। এর বাহারি স্বাদ, নকশা আর প্রকার যেন মুখরোচক করে তুলে দেশীয় লোকজ সংস্কৃতিকে। পিঠাকে কেন্দ্র করে এদেশে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের ঐতিহ্য। এক সময় সকল আতিথেয়তা, আত্মীয়তা, সামাজিক-সম্প্রীতির বন্ধনে পিঠাই ছিল প্রধান উপকরণ। হেমন্তে নতুন ধান ঘরে তুলে, শীত থেকে বসন্ত অব্দি বাংলাজুড়ে চলত পিঠা খাওয়ার ধুম। মূূলত, শীত আসলেই ঘরে ঘরে বয়ে যেত পিঠা উৎসব। স্বাদের সঙ্গে সুন্দর সংস্কৃতির যে আমেজ দেখা যেত তাতেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠত গোটা বাংলা। এই পিঠা তৈরীতে নারী সমাজ নিপুণ কৌশলে যে শৈল্পীক দক্ষতা প্রয়োগ করতেন তা সকল নৈপুণ্যকে নিমিষেই হার মানাতো।

প্রাচীন কাল থেকেই বয়ে যাওয়া এমন মধুর সংস্কৃতি বাঙালি সমাজে এখনও টিকে আছে। মূলত, গ্রামগঞ্জেই এর প্রচলন ছিল ব্যাপক। শহরে পিঠার খুব একটা দেখা মিলত না। তবে, বর্তমানে গ্রাম ছেড়ে শহরেও এর দারুন বিস্তৃত হয়েছে। প্রতিটি অলিগলি, মোড়ে খোলা রাস্তায়, টং দোকানে কিংবা বিশেষায়িত কিছু দেকানেও পিঠা বিক্রির ধুম দেখা যায়। আবার কোথাও কোথাও বসে পিঠা মেলা কিংবা উৎসবের৷ সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়েও বলতে হয় পুরানো দিনের সেই রীতিনিতি আর আমেজ এখন আর দেখা মেলা না।

কিন্তু সেখানে একটু ব্যতিক্রমই বলা যায় সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়কে। হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের এই সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতিবারই সম্পূর্ণ দেশীয় সংস্কৃতির বহিঃরূপ হিসেবে উৎসব পালনের চেষ্টা করা হয়। এখানে যেমন বাঙালিয়ানা থাকে তেমন আদিবাসীদেরও অভিরূপ রয়েছে। এখানে পুরানো দিনের বাঙালি ঐতিহ্যগুলোকে ফুটিয়ে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। থাকে, বাঙালি সংস্কৃতির অপরূপ নির্দশনগুলোও।

৩২ একরের নান্দদিক ক্যাম্পাসটিতে এবারও টানা চতুর্থবারের মতো আয়োজিত হলো পিঠা উৎসব ১৪২৯। আর তাতেই দেখা গেল পুরানোর দিনের সোনালী অধ্যায়কে। সকাল হলেই যেখানে ব্যাগ-বই-খাতার ব্যস্ততা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা সেখানে আজ দেখা গেল রঙিন শাড়ি, পাঞ্জাবি পড়া উৎসবমুখর শিক্ষার্থীদের। নানা সাজ, রঙের স্টল, আলপনার আঁচড় আর বাহারি সাজসজ্জা। সেখানে আজ নেই কোন পড়াশোনার উদ্বেগ। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই যেন এক বাঁধনে, একই উল্লাসে। উৎসবে-আনন্দে ক্যাম্পাসে যেন দেখা গেল প্রজাতির ডানা মেলা।

দোকানে দোকানে নানা বিভাগের নানা নামের স্টল, বাহারি রঙের, ঢঙের পিঠা আর তার মোহনীয় স্বাদ যেন আরেকবার নিয়ে গেল প্রাচীনকালে। সঙ্গে বিক্রেতা শিক্ষার্থীদের আতিথিয়েতা যেন আরেকবার মধুর করে তুলল বাঙালি সংস্কৃতিকে। তাতেই মনে হলো হাজার বছরের এই মধুরতা আজ অব্দিও লেগে আছে প্রতিটি মানুষের মুখে।

এমন অসাধারণ দিনে ফিরে যাওয়ার আয়োজক যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু, আয়োজনের পুরোটাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে। শিল্পীমনা শিক্ষার্থীদের শৈল্পিক সৃষ্টিও তাই ছিল দেখার মতো। গত কয়েকদিনের পরিশ্রম, কষ্টের সৌন্দর্য তারা ফুটিয়েছেন ভিন্ন এক ক্যাম্পাসকে উপহারের মাধ্যমে।

তাইতো শীতের সকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা মেলে সমীকরণের পিঠাঘর, আইনের পিঠা বিলাস, টুনটুনির পিঠাঘর, পিঠাকুঞ্জ, পিঠা বিলাস, আপ্যায়ন, ক্ষীর ব্যাঞ্জন, হাও মাও পিঠা খাও, পৌষের পিঠাঘর ইত্যাদি হরেক নামে, সাজে সজ্জিত দৃষ্টিনন্দন স্টলগুলো। বাদামতলা, ট্রান্সপোর্ট চত্বর, বকুলতলা, মূল ফটক, প্রশাসনিক ভবনের সামনের অংশ সবটাতে দৃষ্টিনন্দন আলপনার সঙ্গে দৃষ্টি কাড়ছে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড আর ফেস্টুন।

বৃহস্পতিবার সকালে বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)-এর নির্বাহী পরিচালক ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সম্মানিত সদস্য ফরিদা আখতার এ পিঠা উৎসবের উদ্বোধন করেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন, রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ এস তাসাদ্দেক আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোঃ সিরাজুল ইসলাম, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোঃ আবু হারিস, বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও বিভাগীয় প্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন।

এবারের, উৎসবে বিভিন্ন বিভাগের ২৫ টি স্টলে গ্রাম-বাংলার প্রায় শতাধিক রকমের পিঠা প্রদর্শিত ও বিক্রি হয়। রকমারি পিঠার গন্ধে যেনো জিভে জল আসার জোগাড়। স্টলগুলো ঘুরে দেখা গেল বাঙালি ঐতিহ্যের নানা রকম পিঠা। পুলি, ভাপা, চিতই, পাটিসাপটা, মাংস পিঠা, নকশা, পাকন, গাজরের বরফি, ক্ষীর পিঠা,কুনাফা, লিনাক্স, অনুসন্ধান, জামাই আদুরী, পেপার পিঠা, ফুলঝুরি প্রভৃতি পিঠার সমাহার।

এর সাথে, আদিবাসীদের নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রদর্শনী গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিঠা উৎসবের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। ছিল ডিবেটিং সোসাইটির আঞ্চলিক ভাষায় বিতর্ক, একদল শিক্ষার্থীর ভালোবাসা বিলাস হিসবে গোলাপ বিক্রির ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। সারাদিনের কোলাহল শেষে জিবিএমসি সহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের গান, নাচের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নামে মুখর সন্ধ্যা। চলে রাত অব্দি আর তার মাধ্যমেই ইতি নামে এই আনন্দ উৎসবের।

গবিতে পিঠা উৎসবের সূচনা ঘটেছিলো গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির হাতে ধরে। ২০১৬ সালে এই সাংবাদিক সংগঠনটির সৃজনশীলতায় এমন অসাধারণ আয়োজনের ব্যপ্তি লাভ করে। এই উৎসবটিই এখন বাঙ্গালির পিঠাপুলির আমেজকে ধারণ করে সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ও ক্যাম্পাসের পুনর্জাগরণ হিসবে স্থান লাভ করেছে।

লেখক: সানজিদা জান্নাত পিংকি শিক্ষার্থী,গণ বিশ্ববিদ্যালয়

পিঠা উৎসব
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত