হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার মধুবৃক্ষ
প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:২৫ | অনলাইন সংস্করণ
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
এক দশক আগেও শীতের সকালে গাছির ব্যস্ততার দৃশ্য চোখে পড়ত। ঘুম থেকে উঠে কাঁধে বাঁশের তৈরি বাঁক নিয়ে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করত। শীতের মৌসুমের শুরু থেকে বাড়ি বাড়ি খেজুরের রস কিংবা রসের পাটালি গুড় দিয়ে তৈরি মজাদার পিঠাপুলির আয়োজন হতো। গ্রাম বাংলার এ দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে মধুবৃক্ষ হিসেবে পরিচিত খেজুর গাছ। গাছিরাও এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
খেজুরের রস এখন আর আগের মতো পাওয়া যায় না। শীত-মৌসুমের প্রধান মজা রসে ভেজা পিঠাসহ অন্যান্য ঐতিহ্যগত আয়োজনও কমে যাচ্ছে। প্রকৃতিগত সুস্বাদু সে রস এখন আর নেই। শীত-মৌসুমে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষকে ঘিরে গ্রামীণ জনপদ থাকত উৎসবমুখর। এ সময় মেহমান আসা মানেই খেজুরের রস ও নতুন চালের ভাঁপা পিঠা-পুলি ও পায়েস দিয়ে আপ্যায়ন। তাছাড়া খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া ও মুড়ি খাওয়ার জন্য কৃষক পরিবার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের শীতের মৌসুম ছিল প্রিয়। কিন্তু আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের বাহক গ্রামগঞ্জ থেকে খেজুরগাছ আজ বিলুপ্তির পথে।
গ্রাম বাংলার হারানো ঐতিহ্য : ভোরে মুক্তাদানার মতো শিশির ভেজা ঘাস। নতুন ধানের মৌ মৌ ঘ্রাণ আর হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা, পাখি ডাকা, ছায়াঘেরা মায়াভরা দিগন্ত প্রসারী সবুজ-শ্যামলে নকশা আঁকা মাঠঘাট ভরা ফসলে। এমনই শীতের সকালে মিষ্টি রোদে বসে সুস্বাদু খেজুরের রস খাওয়ার মজাই আলাদা। মৌসুমি খেজুরের রস দিয়ে শীতের আমেজ শুরু হতো আবহমান বাংলার গ্রামীণ জনপদে। শীতকালে নতুন ধানের চাল দিয়ে বিভিন্ন রকমের পিঠা-পায়েস তৈরিতে খেজুরের রস ও গুড়ের জুড়ি নেই। কিন্তু সেই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খেজুরের রস এখন আর তেমন দেখা যায় না। সময়ের পরিক্রমায় আধুনিক নগরায়নের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা খেজুর গাছ ও রস। একসময় গ্রামীণ অধিকাংশ রাস্তার পাশে, পুকুরপাড়ে ও কৃষিজমির পাশে ছিল প্রচুর খেজুর গাছ। শীত-মৌসুম শুরু হতেই খেজুরের রস সংগ্রহের কাজে গাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ত। সেই রসের চাহিদাও ছিল প্রচুর। বিভিন্ন পিঠা-পুলি ও পায়েসসহ নানান খাবার তৈরির জন্য খেজুরের রস ছিল অন্যতম উপাদান। এজন্য গাছিদের চাহিদার কথা আগেই বলে রাখতে হতো। ফলে যাদের খেজুর গাছ ছিল না, তারাও রস খাওয়া থেকে বঞ্চিত হতো না।
ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ : শীত মৌসুম এলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ বলে খ্যাত খেজুরগাছের রস দিয়ে উৎসব শুরু হতো। খেজুরের রস ও খেজুরের মিঠার গন্ধে গ্রামীণ জনপদ মৌ মৌ করত। শীত আসতেই খেজুর গাছ রসের উপযোগী করতে গাছিরা ব্যস্ত হতো। গাছিরা এ সময় অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হতো। কালের বিবর্তনে অর্থনীতির চাকাকে চাঙ্গা করতে গ্রামীণ ঐতিহ্যের অনেক গাছের মতো খেজুর গাছও কেটে ফেলে লাগানো হচ্ছে কাঠের গাছ। শীতে গ্রামজুড়ে আনন্দময় পরিবেশ বিরাজ করত। পৌষ-মাঘের শীত-মৌসুমে গাছিদের আনন্দের সীমা থাকত না। খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য মহাব্যস্ত হয়ে পড়ত তারা। সকাল হলেই রস সংগ্রহ করত আর বাজারে নিয়ে বিক্রি করত।
খেজুরের রসের পুষ্টিগুণ ও সংগ্রহের সময় : খেজুর গাছ থেকে সংগৃহীত রস মিষ্টি স্বাদের। এ রস শুধু শীতকালে সংগ্রহ করা হয়। খেজুরের রস খনিজ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। আশ্বিন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ অর্থাৎ অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। ঠান্ডা আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ ও কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল পর্যাপ্ত রসের জন্য উপযোগী। এ সময়ে প্রাপ্ত রসের স্বাদও ভালো হয়। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রসের পরিমাণ ও মান কমতে থাকে।
গাছের বয়স : নূন্যতম ৫ বছর বয়সী গাছ থেকে রস সংগ্রহ শুরু করা হয়। গাছের বয়স, এলাকা বা মাটির প্রকারভেদ ছাড়াও একই মৌসুমের বিভিন্ন সময় ও গাছের যতেœর ওপর রসের প্রাচুর্যতা নির্ভর করে। আবার পুরুষ গাছ স্ত্রী গাছের চেয়ে বেশি রস দেয়। রসও তুলনায় বেশি মিষ্টি হয়।
খেজুরের রস সংগ্রহ : খেজুর শুকনো ও মরু অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়ায় এ অঞ্চলের খেজুর খাদ্য হিসেবে খুব একটা ব্যবহার হয় না। তবে এ গাছের রস আকর্ষণীয়। গাছ থেকে রস সংগ্রহের নিয়ম হলো, প্রথমে খেজুর গাছের মাথার অংশের কাছাকাছি ভালো করে পরিষ্কার করে গাছের ভেতরের রস বের করার জন্য গাছের সাদা অংশ বের করতে হবে। এরপর পরিষ্কার করা সেই সাদা অংশ থেকে বিশেষ কায়দায় ছোট-বড় মাটির পাত্র (যেমন ঘটি, কলস ইত্যাদি) দিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। ছোট-বড় বিভিন্ন রকমের খেজুর গাছে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে কোমরে মোটা রশি বেঁধে গাছে ঝুলে খেজুর গাছের রস সংগ্রহের কাজ করতে হয় গাছিদের। গাছিরা প্রতিদিন বিকেলে খেজুর গাছের সাদা অংশ পরিষ্কার করে ছোট-বড় কলসি বাঁধে রসের জন্য। আবার কাকডাকা ভোরে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে নিয়ে যায় বিভিন্ন এলাকায়। কেউ কেউ এ রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাটে-বাজারে (কাঁচা রস) বিক্রি করে। আবার কেউ কেউ সকালেই এ রস দিয়ে বিভিন্ন রকমের পাটালি ও গুড় তৈরি করার কাজ শুরু করেন। গ্রামের অনেক মানুষ শীতের সকালে সুস্বাদু এ খেজুরের রস ও খেজুর রসের তৈরি গুড় নেয়ার অপেক্ষায় থাকে। যা দিয়ে তৈরি হয় মুখরোচক খাবার, পায়েস ও হরেক রকম পিঠা।
হারিয়ে যাওয়ার কারণ : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসজনিত কারণে এখন আর আগের মতো খেজুরের রস খেতে চায় না মানুষ। আর খেজুর রস বিক্রি না হওয়ায় কমে গেছে গাছির সংখ্যাও। মাঝেমধ্যে দুয়েকজনকে দেখা যায় রস সংগ্রহ করতে। তবে বাজারে ক্রেতা কমে যাওয়ায় তারা এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। আগের মতো আর গাছিদের দেখা যায় না। হাতেগোনা দুয়েকজনকে দেখা যায় মাটির হাড়িতে করে ভাড় সাজিয়ে রস ও খেজুর গুড় নিয়ে বেরিয়েছেন গ্রামে। খেজুরের রসের দানা গুড়, ঝোলা গুড়ের ঘ্রাণ এখন আর গ্রামের হাটবাজারে তেমন পাওয়া যায় না। শীতে মিষ্টি খেজুরের রসের স্বাদ আজ ভুলতে বসেছে মানুষ। আগের মতো আর বাজারে পাওয়া যায় না আসল খেজুরের পাটালি। খেজুরের গুড় হিসেবে যা পাওয়া যায়, তার বেশির ভাগই চিনি দিয়ে তৈরি। স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা ও কঠোর নজরদারির অভাবে ইটের ভাটায় অবাধে খেজুরগাছসহ ফলবান বৃক্ষ পোড়ানোর কারণে খেজুর বৃক্ষের বিরাট অংশ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় খেজুর রসের ঐতিহ্য চিরতরে হারিয়ে যাবে। একসময় দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে খেজুরের গুড় রপ্তানি হতো। এখন তা অতীত। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারি উদ্যোগ নেয়া জরুরি। আগে শীত এলে মিষ্টি রোদে বসে খেজুরের রস খেত সবাই। কিন্তু এখন সারা গ্রাম খুঁজেও কোথাও খেজুরের গাছ বা গাছি কারো সন্ধান পাওয়া যায় না। তাই সকলেরই খেজুর গাছ লাগানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খেজুরের রসের কথা শুধু বইপুস্তকে পড়বে; বাস্তবে খুঁজে পাবে না।