বাংলাদেশি পর্যটকদের অভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি বিশেষ এলাকায় ব্যবসায়ীরা বড় ধাক্কা খেয়েছেন। এই এলাকা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের পর্যটকদের কেনাকাটা ও থাকার জন্য জনপ্রিয়। মূলত বাংলাদেশে চলমান সংকট, সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে ভারতীয় নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে দুই দেশের সম্পর্কে যে শীতলতা তৈরি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশি পর্যটকদের না যাওয়ার কারণে কলকাতার ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, একাংশ ব্যবসায়ী এই সংকটে দিশাহীন হয়ে পড়েছেন, অন্যদিকে কিছু ব্যবসায়ী নতুন পথ খুঁজছেন বা অতীতে হারানো ভারতীয় ক্রেতাদের আবার আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। এই পরিস্থিতিতে আনুমানিক ১৫ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ ভারতের তরফ থেকে বাংলাদেশিদের আগের মতো ভিসা না দেওয়াও।
এক ব্যবসায়ী জানান, আগে স্থানীয় ক্রেতা এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্যের পর্যটকেরা বিভিন্ন কারণে এই এলাকাগুলোতে আসতেন। তবে ব্যবসায়ীরা তাঁদের বেশির ভাগ সময় উপেক্ষা করেছেন, যার ফলে ক্রেতার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যায়।
ট্রাভেল এজেন্টস ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার (পূর্ব ভারত) জাতীয় কমিটির সদস্য অনিল পাঞ্জাবি বলেন, ‘এখন বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখা দিয়েছে। তারা জানেন না কী করতে হবে...তাদের ব্যবসা কোন দিকে যাবে তা নিয়েও তারা অনিশ্চিত। কারণ, তাদের সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা বাংলাদেশিদের ওপর।’ তিনি বলেন, ‘উভয় দেশের সরকারকে দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
কলকাতার ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, মার্কুইস স্ট্রিট, সাডার স্ট্রিট, লিন্ডসে স্ট্রিট, কলিন লেন এবং সংলগ্ন এলাকাগুলোতে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাংলাদেশি পর্যটক বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময়, বিমানের টিকিট কেনা, হোটেল বুকিং, রেস্তোরাঁ ও কেনাকাটার জন্য আসেন। তাই এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা প্রতিবেশী দেশের পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন বলে জানান ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক হায়দার আলী খান।
তিনি বলেন, ‘এই সংকটের কারণে আমরা সবাই সমস্যার মধ্যে পড়েছি।’ হায়দার আলী খান আরও বলেন, ‘আমি ৫৫ বছর বয়সী এবং এই এলাকায় বেড়ে উঠেছি। আমি দেখেছি, আমার ছোটবেলায় দুর্গাপূজা ও ঈদের আগে স্থানীয় মানুষ—হিন্দু-মুসলিম উভয়ই—এই এলাকায় কেনাকাটা করতেন।’
কলকাতার এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘ধীরে ধীরে সবকিছু বদলে গেছে। শুধু বাংলাদেশি ক্রেতাদের টানার চেষ্টার কারণে ভারতীয় পর্যটক এবং এমনকি স্থানীয় লোকেরাও এই এলাকা এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। কারণ, এই এলাকা বাংলাদেশি পর্যটকে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।’
হায়দার আলী আরও বলেন, ‘এখানকার ব্যবসায়ীরা বিদেশি পর্যটকদের সেবা দিতে এত ব্যস্ত ছিলেন যে তাদের এই মনোভাবই এখন তাদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতি আরও কিছুদিন স্থায়ী হয়, তাহলে অনেক মানুষ চাকরি হারাবেন এবং কেউ কেউ আত্মহত্যার কথাও ভাবতে পারেন। কারণ, তাঁরা যা অর্জন করেছেন এত দিনে, এখন তা–ও হারানোর পথে রয়েছেন। উভয় সরকারকেই দ্রুত এই সমস্যা সমাধান করতে হবে।’ তিনি জানান, আজ সোমবার এই সমস্যা নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মনতোষ কুমার সাহা জানান, তিনি গত ২৫ বছর ধরে এই এলাকায় ব্যবসা করছেন। বর্তমানে তিনি পরিবহন, হোটেল এবং পাব ব্যবসা পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা পেট্রাপোল বর্ডার থেকে বাস সার্ভিস চালাই এবং বাংলাদেশি যাত্রীদের এখানে নিয়ে আসি, যা তাদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। ৬ ডিসেম্বর মাত্র ১৩০ জন এখানে এসেছিলেন, যেখানে এই সংখ্যা আগে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত হাজারের মধ্যে থাকত।’
এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশি পর্যটকদের সব প্রয়োজন মেটান। এমনকি অন্য জায়গায় বেড়াতে যাওয়া পর্যটকেরাও এখানে না এসে ফিরে যান না বলে সাহা দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা তাঁদের শিক্ষা পেয়েছেন এবং ভবিষ্যতে শুধু বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল না থাকার কথা ভাবছেন। এখন আমাদের সামনে কাজ হলো অন্যান্য রাজ্য এবং স্থানীয় লোকদের আকৃষ্ট করা, যাতে তারা পুরোনো দিনের মতো এখানে আসে।’
মনতোষ সাহা আরও বলেন, ‘আমি আমার কর্মচারীদের জানিয়ে দিয়েছি, ডিসেম্বরের ৩১ তারিখের পর আমি বার এবং হোটেল চালাতে পারব না। যদি বাংলাদেশে পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, আমাকে তাদের চাকরি থেকে ছাঁটাই করতে হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, আগে যেখানে তাঁর বার ও হোটেলে উপস্থিতি সব সময় পূর্ণ থাকত, এখন তার অর্ধেকও হয় না।
এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘আমার হোটেলে ২৮টি কামরা আছে, আর শুক্রবার মাত্র চারটি ঘর ভাড়া হয়েছে। বাংলাদেশে সংকট শুরুর আগে সব কামরা পূর্ণ থাকত।’
এই এলাকার কিছু ব্যবসায়ী বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য সরবরাহ করতেন এবং তাঁদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা আদায় বাকি রয়েছে। এ নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন বলে জানান অনিল পাঞ্জাবি। এই অনিশ্চয়তার মুখে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এখন আজকের বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছেন।