হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েনে ভারত
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:১৩ | অনলাইন সংস্করণ
পদচ্যুত স্বৈরশাসক হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এ বছরেরর মাঝামাঝিতে সম্পর্কে ফাটল তীব্রতা দৃশ্যমান হয়। যা হাসিনার সময় ছিল খুবই ঘনিষ্ট। দুই দেশের বর্তমান সম্পর্ক কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ ছাত্র বিক্ষোভের ফলে শুরু হওয়া আন্দোলন শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার মসনদ কাঁপিয়ে তোলে। বাংলাদেশের স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ‘দেশব্যাপী আন্দোলনে’ পরিণত হয়।
ছাত্র-জনতার এই গণআন্দোলনকে “বিশ্বের প্রথম জেন-জি বিপ্লব” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। দুনিয়াজুড়ে সাড়া ফেলে দেয়া এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং এরপর থেকে তিনি দিল্লিতেই অবস্থান করছেন।
এর পরের মাসগুলোতে নানা ঘটনাবলীর প্রেক্ষপটে বাংলাদেশে এক হিন্দু নেতাকে গ্রেপ্তার এবং ভারতে বাংলাদেশের একটি দূতাবাসে উগ্র হিন্দুত্ববাদী জনতার হামলার ঘটনা দুই দেশের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। এখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে এবং সম্পর্কের মধ্যে ধর্মীয় উত্তেজনাও চোখে পড়ছে।
‘আয়রন লেডি’ খ্যাত শেখ হাসিনার কট্টর ও স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে তার অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীল অংশীদার বলে মনে করেত। যদিও আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা সবাই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামল গত আগস্টে তাসের ঘরের মতো আকস্মিকভাবে ভেঙে পড়ার পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়।
বাংলাদেশের ১৭৪ মিলিয়ন বা ১৭ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ এবং তাদের অনেকেই ঐতিহাসিকভাবে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারানোর পর বিক্ষুব্ধ অনেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন প্রতীক এবং কিছু ক্ষেত্রে দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হিন্দুদেরও টার্গেট করেছিল।
সেই সময়ে ড. ইউনূস সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে “অর্থহীন সহিংসতার” তীব্র নিন্দা করেছিলেন। হামলা বন্ধ না হলে পদত্যাগ করার হুমকিও দেন তিনি। ড. ইউনূস জানিয়েছিলেন, সহিংসতা আমাদের শত্রু। দয়া করে আর শত্রু তৈরি করবেন না। শান্ত হোন। দেশ গড়তে প্রস্তুত হন।
এরপরও ভারত ড. ইউনূসের সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট কাজ না করার অভিযোগ করেছে। ভারতে থাকা হাসিনাও দাবি করেছেন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে “গণহত্যার” জন্য দায়ী এই সরকার।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং গত সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-গাজার মধ্যে চলমান সংঘাত এবং বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উল্লেখ করে “অপ্রত্যাশিত” পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু গত নভেম্বরের শেষের দিকে বাংলাদেশে একজন হিন্দু সন্ন্যাসীকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এটি ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি করে। চলতি বছরের অক্টোবরে এক সমাবেশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করার অভিযোগে হিন্দু নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তার সমর্থকদের বিশ্বাস, হিন্দুদের বিরুদ্ধে হামলার বিষয়ে সোচ্চার থাকায় তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। যদিও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ভারতীয় এক সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন, হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার দাবিগুলো বেশিমাত্রায় রঞ্জিত করে সবার সামনে আনা হয়েছে।
ইতোমধ্যেই ভারতে উগ্র কট্টরপন্থি হিন্দু গোষ্ঠী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি অনেক দলই ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছে। দুই দেশের সরকার — যারা দীর্ঘদিন ধরে একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও উষ্ণ সম্পর্ক উপভোগ করেছে। তারা এখন ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে ভারতকে নিয়ে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো অমিত রঞ্জন বলেন, বাংলাদেশি সমাজের সবসময়ই এই অনুভূতি থাকে যে— বাংলাদেশের বিষয়ে খুব বেশি হস্তক্ষেপ করে ভারত। বাংলাদেশিদের এই অনুভূতিও আছে যে— হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন টিকে ছিল ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের জোরাল সমর্থনে।
বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির গবেষক খন্দকার তাহমিদ রেজওয়ান বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শুধুমাত্র শেখ হাসিনার আওয়ামী শাসনামলের সঙ্গে উষ্ণ ছিল, সাধারণ মানুষের সঙ্গে নয়। এখানে বাংলাদেশে আমরা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বলে উপহাস করতাম।
শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতীয় কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ড. ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে এবং বাংলাদেশের পতাকা অবমাননা করেছে। আর উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের এমন ছবি যা বাংলাদেশে ভারতের প্রতি ক্ষোভ আরো বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।
এবং চলতি ডিসেম্বর মাসের শুরুতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে সম্প্রতি হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার সময় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা সেখানে ভাঙচুর চালায় এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলার পাশাপাশি অবমাননা করে।
আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হামলার পর ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে এবং এই হামলাকে ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন বলে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এই ঘটনায় সাত বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং ঘটনাটিকে গভীরভাবে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছে। এছাড়া গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে সম্পর্কের আরো উত্তাপ কমাতে এবং একইসঙ্গে উভয় দেশের মধ্যে প্রথম শীর্ষ পর্যায়ের কূটনৈতিক যোগাযোগের অংশ হিসেবে চলতি মাসে ঢাকা সফর করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন ২০২৫ সালের শেষ দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হবে। হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে সহায়ক ভূমিকা রাখা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সম্ভবত বেশ ভালোভাবেই ওই নির্বাচনে জয় পাবে এবং সরকার গঠন করতে পারে। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা জেনসের সিনিয়র বিশ্লেষক শিবানী গায়কওয়াদ বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে বিএনপি তার চীনপন্থি অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। তিনি বলেন, চীনপন্থি এবং ইসলামপন্থি অবস্থান নিয়ে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা খুব সম্ভবত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, চলতি বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্যান্য আরো বেশ কয়েকটি অভিযোগের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জারি করেছে।
বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির গবেষক খন্দকার তাহমিদ রেজওয়ান বলছেন, হাসিনাকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার যে কোনো প্রচেষ্টা ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি এবং বিরোধীদল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস উভয়ের দ্বারাই প্রতিরোধের মুখে পড়বে।
তিনি বলেন, ভারত চাইবে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হোক, পুনর্গঠিত হোক এবং মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসুক। তবুও বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ভারত সরকার তাকে ( শেখ হাসিনাকে) বাংলাদেশ সরকারের হস্তান্তর করতে প্রস্তুত কিনা তার ওপর। অস্ট্রেলিয়ায় ৭ বছর নির্বাসনের পর বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কর্মী মোবাশ্বর হাসান শেখ হাসিনার পতনের পরিপ্রেক্ষিতে তার জন্মভূমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন।
ডা. হাসান এবিসির দ্য ওয়ার্ল্ডকে বলেছেন, ভারত যদি শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকার করে, তাহলে আমরা বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে আরো ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়তে পারে। তারা পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী সরকারকে ফ্যাসিবাদী বলে আখ্যায়িত করে থাকে এবং সেই সরকার ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া সমর্থনেই টিকে ছিল বলে মনে করে।