ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় প্রবেশের জন্য এক হাজার ৩০০ ত্রাণবাহী ট্রাক প্রস্তুত আছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের মুখপাত্র রোজালিয়া বোলেন।
শনিবার (১৮ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরা।
রোজালিয়া বোলেন আলজাজিরাকে বলেছেন, ‘ইউনিসেফের পক্ষ থেকে ১৩০০ ট্রাক প্রস্তুত। এরপর ত্রাণবাহী আরও ৭০০ ট্রাক গাজায় প্রবেশ করতে পারবে। আমরা একা নই, অন্যান্যরা এসব মানবিক সহায়তা প্রস্তুতে কাজ করছেন।’
ইউনিসেফের এ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গাজার অনেক মানুষ উত্তরাঞ্চল থেকে আল-মাওয়াসির দিকে এসেছেন। যখন যুদ্ধবিরতি শুরু হবে, তখন সেখানকার বাসিন্দারা আবারও নিজ বাড়িতে ফেরা শুরু করতে পারেন।
বিষয়টি জটিল হবে জানিয়ে তিনি বলেছেন, এ বিষয়টির সঙ্গে সমন্বয় করে তারা তাদের ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম চালাবেন।
দখলদার ইসরায়েলের সঙ্গে হামাসের যে চুক্তি হয়েছে সে অনুযায়ী, গাজার উত্তরাঞ্চলের মানুষ ধীরে ধীরে সেখানে যেতে পারবেন। তবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরই সাধারণ জনতা ওইদিকে যাওয়া শুরু করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ইসরায়েলি সেনারা যেহেতু গাজায় অবস্থান করবে এবং সেখানে অনেক অবিস্ফোরিত বোমা বা অন্যান্য জিনিসপত্র থাকতে পারে, তাই সবাইকে ধৈর্য ধরে উত্তরাঞ্চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে গাজার সিভিল ডিফেন্স।
সংস্থাটির মুখপাত্র বলেছেন, ‘তাড়াহুড়া করে উত্তরাঞ্চলের দিকে যাবেন না। কারণ, সেখানে অবিস্ফোরিত যুদ্ধাস্ত্র থাকতে পারে।’
উত্তরাঞ্চলের ৯০ শতাংশ ঘরবাড়ি পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংস হয়ে গেছে। এসব ধ্বংস হওয়া বাড়িও জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে জানিয়েছেন গাজার সিভিল ডিফেন্সের এই মুখপাত্র।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে ঢুকে হামলার চালানোর পরদিন থেকে থেকে প্রতিশোধ নিতে শুরু হয় যেই অসম যুদ্ধ, তাতে অবরুদ্ধ উপত্যকাটির প্রায় প্রতিটি পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। নির্বংশ হয়ে গেছে অনেক পরিবার। অর্থাৎ এসব পরিবারের আর কোনো সদস্য জীবিত নেই। ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ঘর-বাড়ি, স্কুল-হাসপাতাল এবং রাস্তা-ঘাটসহ নানা অবকাঠামোর যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগবে।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গাজায় ইসরায়েলি হামলা প্রাণ হারিয়েছেন ৪৬ হাজার ৮৭৬ জন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১০ হাজার ৬৪২ জন। এদের মধ্যে অনেকে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। যুদ্ধবিরতি শুরুর ঘোষণার মধ্যেও থেমে নেই ইসরায়েলি হামলা। সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮৮ জন। আহত হয়েছেন ১৮৯ জন।
যুদ্ধের তীব্রতা গাজার ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকাকে সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের উপাত্ত সংগ্রহ করে ক্ষয়ক্ষতির একটি চিত্র তুলে ধরে বলছে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় গাজার ৩৬টির মধ্যে ১৮টি হাসপাতাল আংশিকভাবে কার্যকর রয়েছে, যার মোট ধারণক্ষমতা ১ হাজার ৮০০ বেড। আর ইউনিসেফ বলছে, গাজার ৪৯৬টি স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা মোট স্কুলের ৮৮ শতাংশ। এর মধ্যে ৩৯৬টি সরাসরি হামলায় বিধ্বস্ত।
অন্যদিকে জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজার ১০৩ বর্গকিলোমিটার কৃষিজমি ধ্বংস হয়েছে, যা মোট কৃষিজমির ৬৮ শতাংশ। রাস্তাঘাটের ৬৮ শতাংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১ হাজার ১৯০ কিলোমিটার রাস্তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে এবং ৪১৫ কিলোমিটার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আমেরিকা, মিসর, কাতারের প্রচেষ্টায় যুদ্ধবিরতির চুক্তি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন শুরু হয়, তাহলে তা গাজাবাসীর জন্য স্বস্তি নিয়ে আসবে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অস্থিতিশীলতাও কমে আসতে পারে। কারণ এই যুদ্ধ ঘিরেই লেবানন, ইয়েমেন ও ইরাকের প্রতিরোধ অক্ষের গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে।
গাজা উপত্যকায় এখন একটা নির্মল সুন্দর দিনের অপেক্ষা। যেদিনের পর থেকে পেছনের দুঃসহ স্মৃতিগুলো ভুলে ঘুরে দাঁড়াবে গত ৭৫ বছর ধরে নির্যাতিত ফিলিস্তিনিরা।