বেতনভুক্ত চাকরিজীবী দায়িত্ব পালনকালে কাজের বিনিময়ে গ্রাহক থেকে নির্ধারিত ফি এর চেয়ে অতিরিক্ত চেয়ে নেওয়া ঘুষের শামিল। এমন পরিস্থিতি তৈরি করাও জায়েজ নেই যে, গ্রাহক হাদিয়া নামে টাকা দিতে বাধ্য হয়ে যায়। নিশ্চয়ই এটি ঘুষের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দরবারে একজন কর্মচারী কিছু মাল এনে বলল, এটা আপনাদের (সরকারি) মাল, আর এটা আমাকে দেওয়া হাদিয়া। রাসুলুল্লাহ (স.) এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, সে তার বাবা-মার ঘরে বসে থাকল না কেন, তখন সে দেখতে পেত- তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কি-না? (বুখারি: ২৫৯৭ ‘হেবা ও তার ফজিলত’ অধ্যায়)
ওই কর্মচারীর কথা শোনার পর ভাষণে নবীজি (স.) বলেন, ..‘আল্লাহর কসম, তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোনো জিনিস অনধিকার গ্রহণ করবে, সে কেয়ামতের দিন তা নিজ ঘাড়ে বহন করা অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করবে। অতএব আমি যেন অবশ্যই চিনতে না পারি যে, তোমাদের মধ্য হতে কেউ নিজ ঘাড়ে চিঁহি আওয়াজবিশিষ্ট উট, অথবা হাম্বা রববিশিষ্ট গাই, অথবা মে মে রববিশিষ্ট ছাগল বহন করা অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করেছে।’ আবু হুমাইদ (র.) বলেন, অতঃপর নবী (স.) উভয় হাতকে (মোনাজাতের সময়) উপর দিকে এতটা তুললেন যে, তাঁর উভয় বগলের শুভ্রতা দেখা গেলো। অতঃপর তিনবার বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কি পৌঁছে দিলাম?’ (মুত্তাফাকুন আলাইহ)
তাই বকশিশ চাওয়া বন্ধ করা আবশ্যক। যদি চাওয়া ছাড়া, এমনিতে সার্ভিসে খুশি হয়ে কেউ কিছু হাদিয়া দেয়, তাহলে সেটা গ্রহণ জায়েজ হবে। অন্যদিকে চাওয়া বা চাওয়ার পরিবেশ তৈরি করে পাওয়া পুরোটাই ঘুষের হুকুমে নাজায়েজ হবে। আবু হুররাহ আর রক্কাশি (রহ) তাঁর চাচা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, কারো মাল তার মনোতুষ্টি ছাড়া কারো জন্য হালাল নয়। (মুসনাদে আবু ইয়ালা মুসিলি: ১৫৭০, দারা কুতনি: ২৮৮৬, সুনানে কুবরা লিলবায়হাকি: ১১৫৪৫, শুয়াবুল ঈমান লিলবায়হাকি: ৫৪৯২, মেশকাত: ২৯৪৬)
ঘুষ সর্বসম্মতিক্রমে হারাম বা নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে-বুঝে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারককে উৎকোচ দিও না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)
কারো ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকে কিছু দেওয়াকেও ঘুষ বলা হয়। কখনো আবার কোনো মধ্যস্থতাকারীকে ব্যবহার করে চুক্তির মাধ্যমেও নেওয়া হয়। কেউ আবার এটিকে নিজের অধিকার ভেবে সরাসরি চেয়ে বসে। পার্থক্য হলো, কারো চাওয়ার ধরণ ভিক্ষুকের মতো হয়, আবার কেউ মাস্তানদের মতো মানুষকে জিম্মি করেও তা আদায় করে থাকে। কেউ আবার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের গুণগান গাওয়াসহ বিভিন্ন উপায়ে ঘুষ নিয়ে থাকে। কেউ কেউ পরিচিত মুখ দেখলে ঘুষ চাইতে পারে না, তাই ওই বেচারার কাজও শেষ পর্যন্ত হয় না। এসব পরিস্থিতির মূলে থাকে কিছু হারাম অর্থ। অথচ রাসুল (স.) সাবধান করেছেন, ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামি।’ (মু’জামুল আউসাত: ২০২৬)
নবীজি (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে দেহের গোশত হারাম উপার্জনে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম ধন-সম্পদে গঠিত ও লালিত পালিত দেহের জন্য জাহান্নামই উপযোগী। (মেশকাত: ২৭৭২; আহমদ: ১৪৪১, শুয়াবুল ঈমান: ৮৯৭২)
রাষ্ট্র জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স বসিয়ে টাকা আদায় করে জনগণেরই খেদমত করার জন্য বেতন দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করে। এসব বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর ওয়াজিব হলো, যে কাজের জন্য তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে, সে কাজ তাকে করে দেওয়া। এর বিনিময়ে উপরি কিছু গ্রহণ করতে পারবে না। ওই বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি তাদের নিজ নিজ এলাকায় জনগণের কাছ থেকে উপহার নেয়, জনগণের বাড়িতে দাওয়াত খায়, জনগণের কাছ থেকে কোনো হাদিয়া, তোহফা গ্রহণ করে বা তাদের ছেলেমেয়ে বা স্ত্রীর জন্য মিষ্টি বা নাশতা খাবার গ্রহণ করে, তবে তার সবই ঘুষ হবে। হারাম হবে। আমানতের খেয়ানত হবে। গোনাহে কবিরা হবে।’ (বেহেশতি জেওর-পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪০৮)
ঘুষগ্রহণের ফলে ইবাদত, দোয়া কবুল হয় না। একবার রাসুল (স.)-এর কাছে একটি আয়াত তেলাওয়াত করা হলো, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী ভক্ষণ করো। ’ তখন সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন আমার দোয়া কবুল হয়। রাসুল (স.) বলেন, হে সাআদ, তোমার পানাহারকে হালাল করো, তবেই তোমার দোয়া কবুল হবে। (আল মুজামুল আউসাত: ৬৪৯৫)
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায়, সে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আগমন করবে যে তার মুখমণ্ডলে এক টুকরা গোশতও থাকবে না। ’ (বুখারি: ১৪৭৪) হাদিয়া নামে ঘুষ, চাকরিজীবী ঘুষ হারাম
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে হারাম অর্থ উপার্জন থেকে রক্ষা করুন। হাদিয়ার নামে ঘুষ দেওয়া নেওয়া থেকে বিরত রাখুন। আমিন।