নবী প্রেমিকের বীরত্বগাঁথা 

প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:৩৫ | অনলাইন সংস্করণ

  মুফতি ইবরাহীম আল খলীল

১৯২০ সাল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় ‘রঙ্গিলা রাসুল’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এখানে ‘রঙ্গিলা’ অর্থ ছিল ‘প্রমোদবালক’ বা ‘প্লে বয়’। বইটির লেখক প্রসাদ প্রতাপ। লিখেছিল চিমোপতি লাল পণ্ডিত ছদ্মনাম নামে। রাজপাল নামে লাহোরের এক হিন্দু পুস্তক ব্যবসায়ী ১৯২৩ সালে বইটি প্রকাশ করে। লেখকের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ না করার ঘোষণা দিয়ে। 

পুরো হিন্দুস্তান উত্তাল। আন্দোলনে টালমাটাল সারা দেশ। পণ্ডিত চিমোপতি লাল রচিত রাসুলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র বৈবাহিক জীবন নিয়ে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যে ভরপুর কুখ্যাত বই ‘রঙ্গিলা রাসুল’ প্রকাশের অপরাধে প্রকাশক রাজপালের বিরুদ্ধে চলছে জোরালো আন্দোলন। অপরদিকে ইংরেজ সরকার নীরব। মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যোবোধকে বিনষ্ট করার মানসে হিন্দুদেরকে ধর্মীয় উস্কানিমূলক সকল কাজের বৈধতা দিয়ে রেখেছে ইংরেজ সরকার। মুসলমানরা দগ্ধ হৃদয় নিয়ে প্রকাশক রাজপালের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে বারবার সরকারের কাছে আবেদন করেছে। কিন্তু প্রতিবারই তাদেরকে ব্যর্থ মনোরথে ফিরতে হয়েছে। উল্টো ইংরেজ সরকার প্রকাশক রাজপালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ নিয়োগ করেছে। মুসলমানরা যেনো আন্দোলন করে রাজপথ উত্তপ্ত করতে না পারে এজন্য ফিরিঙ্গিরা পূর্বেই ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী আলেমদের ওপর চলে বিভিন্ন জুলুম। নির্যাতন করে আন্দোলনকে নির্বাপিত করতে চেয়েছে। কিন্তু এতে মুসলমানদের ভেতরের জ্বলন শুধু বেড়েছেই। একটুও কমেনি।

১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মুসলমানরা সেদিন দিল্লি দরজার অভ্যন্তরে শাহ মুহাম্মাদ গওস রহ. চত্বরে সমবেত হয়। সমাবেশে নেতৃত্ব দান করেন আশিকে রাসুল আমিরে শরিয়ত সাইয়িদ আতাউল্লাহ শাহ বুখারি রহ.। শাহজি রহ. সেদিন নবীপ্রেমে ব্যাকুল হয়ে এমন ঈমানদীপ্ত অগ্নিঝরা বক্তৃতা করেন, যা শ্রোতাদের হৃদয়ে দাউ দাউ করে নবীপ্রেম আর ঈমানের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে। সেই সমাবেশে মুফতি কেফায়াতুল্লাহ রহ. এবং মাওলানা আহমদ সাঈদ দেহলবি রহ.ও উপস্থিত ছিলেন।

অদ্ভুত রায়ে মুক্তি পায় রাজপাল 

বিক্ষোভ চরমে পৌঁছায়। লাহোর সেশন কোর্টে মুসলিম আইনজীবীরা মামলা করেন। রাজপালকে দাঙ্গা বাঁধানোর প্রচেষ্টায় দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেয় সেশন কোর্ট। রাজপাল সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। আপিল আদালতে শুনানি করে জজ দিলীপ সিং। দিলীপ সিং তার সংক্ষিপ্ত রায়ে উল্লেখ করে, ‘এটা ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের সেকশন ১৫৩ লঙ্ঘন করে না।’ অর্থাৎ তাকে দাঙ্গা সৃষ্টির অভিযোগ থেকে অদ্ভুত এক রায়ের মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়। রাজপাল মুক্তি পায়। রাজপাল কোন শাস্তি পেলো না উপরন্তু সে পুলিশ পাহারাও পেয়ে গেল।

এই ঘটনা লাহোর থেকে ঢাকা সর্বত্রই মুসলিমদের কাছে ঘৃণ্য বলে পরিগণিত হয়। বিক্ষোভ, মিছিল, সিরাত সম্মেলন চলতে থাকে। সময় এগোতে থাকে আর র্দ্বুার আন্দোলনের গতি বাড়তে থাকে। সেদিনই আঞ্জুমানে খুদ্দামুদদীন শহরের ফটকে ফটকে রাজপালকে হত্যা করা ওয়াজিব মর্মে ফতওয়া টানিয়ে দেয়া হয়। আলেম-ওলামা ও জনসাধারণ সকলের যবানেই ‘শাতিমে রাসুল’কে জাহান্নামের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর অপরিহার্যতার কথা চর্চা হতে থাকে।

নবীপ্রেমে উতলা যুবক

গাজি ইলমুদ্দিন শহিদ। লাহোরের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ৪ ডিসেম্বর ১৯০৮ তারিখে জন্মগ্রহণ করে। তার বাবার নাম তালেমন্দ। পেশায় কাঠমিস্ত্রি। লাহোরে এবং তার আশপাশে সততা এবং দক্ষতার কারণে তাদের ভালো সুনাম ছিলো। সম্মানের সাথেই দিনাতিপাত করছিলেন। খুব বড় হওয়ার এবং অনেক সম্পদধারী হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। আর দশটি পরিবারের মতো স্বাভাবিকভাবেই জীবনের ধাপগুলো অতিক্রম করার আকাক্সক্ষা ছিল। সেসময়ে শিশুরা মসজিদ থেকেই প্রাথমিক জ্ঞানার্জন করত। তালেমন্দ তার ছেলেকেও কোরআন শেখার জন্য মসজিদে পাঠিয়েছিলেন। গাজি ইলমুদ্দিন কিছুদিন সেখানে যাতায়াত করে। কিন্তু অধিক বিদ্যাবুদ্ধি অর্জন করা আর তার নসিবে জোটেনি।

ইলমুদ্দিন বাবার হাত ধরে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পেশায় আত্মনিয়োগ করে। বাবার মতো সেও একজন ভালো কাঠমিস্ত্রি হয়। ইলমুদ্দিন বাবার সাথে কাজের প্রয়োজনে লাহোরের বাইরেও বিভিন্ন সময়ে গমন করত। ইলমুদ্দিন এক সাদাসিধে মুসলমান। সে দিনরাত তার পেশায়ই ডুবে থাকে। জগতের কোনো খোঁজখবরই তার কাছে নেই। রাজপালের ঘৃণ্য উদ্যোগে সারা হিন্দুস্তান যে উত্তাল, এর বিন্দুমাত্র খোঁজও ইলমুদ্দিনের ছিল না। একদিন সন্ধ্যা বেলা কাজ শেষ করে ইলমুদ্দিন ঘরে ফিরছিল। দিল্লি দরজার কাছে এলে সেখানে এক বিশাল সমাবেশ দেখতে পায়। ডায়াস থেকে এক নওজোয়ানের অগ্নিঝরা বক্তৃতার আওয়াজ তার কানে ভেসে আসে। সে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়ায়।

পাশের এক ব্যক্তিকে অবস্থা জিজ্ঞেস করলে সে তাকে জানায়, রাজপাল নামের এক হিন্দু প্রকাশক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে গোস্তাখিমূলক বই প্রকাশ করেছে। তার প্রতিবাদে আজকের এ সমাবেশ। কথাটা ইলমুদ্দিনের ভেতরে স্পন্দন জাগায়। রাজপালের দুঃসাহসিকতা তার হৃদয়কে চরমভাবে আহত করে। ইলমুদ্দিন দীর্ঘক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে আলোচনা শুনতে থাকে। ইলমুদ্দিন খুব মনোযোগের সাথে আলোচনা শোনে। সাথে সাথে সেখান থেকেই সে জানতে পারে, রাজপাল তার এই দুঃসাহসিক কাজের কারণে ‘ওয়াজিবুল কতল’ তথা তাকে হত্যা করা অপরিহার্য। ইলমুদ্দিনের মনে নবীপ্রেমের ঝড় ওঠে। তার চিন্তাভাবনা মনমানসিকতা মুহূর্তেই সব বদলে যায়। কালিমায় এতোদিন একশ্বাসে যে মহান ব্যক্তির নাম নিতো, আক্ষরিক জ্ঞানহীন সে মানুষটি যে নবীকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, সেই রাসুলের শানে এই চরম বেয়াদবি আর গোস্তাখিকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। ইলমুদ্দিনের হৃদয়জগৎকে নবীপ্রেম ছুঁয়ে যায়।

সে রাতে ঘুমোতে পারেনি ইলমুদ্দিন

সে রাতে ইলমুদ্দিনের আর ঘুম হয়নি। পরবর্তী দিন সে তার বন্ধু শেদার সাথে সাক্ষাৎ করে। শেদাকে সব খুলে বলে। সেই দিনগুলোতে পুরো হিন্দুস্তানজুড়ে মুসলমানদের মূল আলোচনার বিষয় এই একটাই ছিল। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে হাট-বাজার সর্বত্রই চলছিল রাজপালের দুঃসাহসিকতা ও আস্পর্ধা নিয়ে আলোচনা। ইলমুদ্দিন নিয়মিত শেদার সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও পরামর্শ করতে থাকল। কাজকর্ম ও নাওয়াখাওয়া কোনো কিছুতেই তার আর মন ছিল না। নবীপ্রেমের ভাবনা খেলে যাচ্ছে ইলমুদ্দিনের বুকে। কেউ ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি, এই ছেলে নিজের জন্য জান্নাতের সওদা করছে।

ইলমুদ্দিন আর শেদা অনেক খুঁজেফিরেও জানতে পারে না যে, কে এই নরাধম রাজপাল আর কোথায়ই বা তার দোকান। সে দেখতেই বা কেমন। পরিশেষে শেদার এক বন্ধুর মাধ্যমে তারা জানতে পারে যে, রাজপালের লাইব্রেরি হাসপাতাল রোডে।

ইলমুদ্দিনের স্বপ্ন এক রাতে ইলমুদ্দিন স্বপ্নে দেখে, এক বুযুর্গ এসে তাকে বলছেন, “ইলমুদ্দিন, এখনও ঘুমিয়ে আছো?! দুশমন তোমার নবীর শানের খেলাফ প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত। উঠো। জলদি করো।” ইলমুদ্দিনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আর ঘুমোতে পারেনি সে। উত্তেজনায় তার সারা শরীর ঘেমে ভিজে যায়। সে অস্থির হয়ে পড়ে। এরপর ঘুমানোর চেষ্টা করেও আর ঘুমাতে পারে না। অনন্তর উঠে সরাসরি শেদার ঘরে পৌঁছে। তাকে সব খুলে বলে। এখানে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ইলমুদ্দিন রাতে যে স্বপ্ন দেখেছে, হুবহু একই স্বপ্ন শেদাও দেখেছে। স্বপ্নে দেখা বুযুর্গ উভয়কে একই আদেশ দিয়েছেন। তারা উভয়েই পেরেশান। এবার কে তাহলে এই দায়িত্ব আঞ্জাম দেবে। দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। উভয়ই এই গুরুদায়িত্ব নিজ হাতে সম্পন্ন করতে চাচ্ছিলো। আখের আলোচনার মাধ্যমে কোনো ফায়সালা করতে না পেরে তারা লটারি করে। লটারিতে ইলমুদ্দিনের নাম ওঠে। শেদার অনুরোধে পুনরায় লটারি করা হয়। এবারও ইলমুদ্দিনের নাম ওঠে। শেদার পীড়াপীড়িতে তৃতীয়বার লটারি করলে এবারও ইলমুদ্দিনের নাম ওঠে। ইলমুদ্দিন নিশ্চিন্ত হয়ে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বাড়িতে ফেরে।

আবারও ইলমুদ্দিন স্বপ্ন দেখে, সেই বুযুর্গ এসে তাকে বলছেন, “উঠো! জলদি করো! দেরি করবে তো অন্য কেউ এসে বাজি নিয়ে যাবে!”
 

গ্রেফতার হয় ইলমুদ্দিন

৬ এপ্রিল ১৯২৯ সাল। ইলমুদ্দিন সকালবেলা ঘর থেকে বের হয়। গুমটি বাজারের দিকে যায়। আত্মারাম কামারের দোকানে গিয়ে সেখান থেকে নিজের পছন্দমতো একটি ছুরি কিনে। ছুরি কেনার পর সে অনেকটা আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তৎক্ষণাৎই হাসপাতাল রোডে পৌঁছে। আনারকলি হাসপাতাল রোডে ইশরত পাবলিশিং হাউজের সামনেই রাজপালের দোকান ছিল। সেখানে পৌঁছে ইলমুদ্দিন জানতে পারে, রাজপাল এখনও আসেনি। আর যখন সে আসে, তখন তার হেফাজতে পুলিশও এসে হাজির হয়। ইতোমধ্যে রাজপালের দোকানের সামনে এসে একটি গাড়ি থামে। ইলমুদ্দিন জানতে পারে, গাড়ি থেকে যে লোকটা নামছে, সে-ই রাজপাল। এই নরাধমই রাসুলের শানে গোস্তাখিমূলক বই প্রকাশ করেছে।

রাজপাল গাড়ি থেকে নেমে সাহেবের মতো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। দোকানে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে পুলিশকে তার আগমনের কথা জানানোর জন্য টেলিফোন উঠানোর কথা ভাবছে এমন সময় ইলমুদ্দিন দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। সেসময়ে অফিসে দু’জন কর্মচারী ছিল। রাজপাল এক তরুণকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে, কিন্তু সে ভাবতেই পারে না যে, মৃত্যু তার এতোই কাছে। ইলমুদ্দিন ভেতরে প্রবেশ করে চোখের পলক পড়ার আগেই জামার ভেতর থেকে ছুরি বের করে। তার হাতটা উঁচুতে উঠে যায় এবং মুহূর্তের মধ্যেই ধারালো ছুরির আঘাত রাজপালের বুকে গিয়ে বিদ্ধ হয়। ছুরির ফলা রাজপালের কলজে ভেদ করে। এক আঘাতেই আহ শব্দ উচ্চারণ করে রাজপালের দেহ মুখ থুবড়ে জমিনে পড়ে। ইলমুদ্দিন দ্রæত পেছনে ফিরে দোকান থেকে পলায়ন করে। দোকানের দুই কর্মচারী বাইরে এসে চিৎকার করতে থাকে, “ধরো! ধরো! বলে।” 

কাশ্মীর থেকে রাসকুমারি পর্যন্ত চারিদিকে দাবানলের মতো গাজি ইলমুদ্দিনের বাহাদুরির কথা ছড়িয়ে যায়। সর্বত্র এই ঈমানদীপ্ত তরুণের কালজয়ী কারনামার কথা আলোচনা হতে থাকে। গাজি ইলমুদ্দিন নবীপ্রেমের নযরানা পেশ করার অপরাধে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়।

ফাঁসি হয় নবীপেমিকের 

ঈমানের চেতনার দাবিতে অবশেষে গাজি ইলমুদ্দিনের পক্ষে একঝাঁক মুসলিম ওকিল সাড়া দেন। ব্যারিস্টার খাজা ফিরোজ উদ্দিন, ব্যারিস্টার ফারাখ হুসাইন এবং তাদের সহযোগিতায় ডা. এ আর খালেদ, মাস্টার সেলিম এবং আরো কয়েকজন আল্লাহর বান্দা এই মামলার পক্ষে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওকিলরা গাজি ইলমুদ্দিনের পক্ষে অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন। অসংখ্য দলিল ও আইনের ধারা পেশ করেন। কিন্তু ফায়সালা তো পূর্বনির্ধারিত। ৯ মে ১৯২৯ তারিখে গাজি ইলমুদ্দিনের ব্যাপারে মৃত্যুদÐ ঘোষণা করা হয়।
লাহোর হাইকোর্টের কট্টর হিন্দু জাস্টিস শাদিলাল কোনো কথায় কর্ণপাত না করে আপিল খারিজ করে দেয়। এরপর ফাঁসির জন্য গাজি ইলমুদ্দিনকে মিয়ানওয়ালি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩১ অক্টোবর ১৯২৯ তারিখে গাজি ইলমুদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অতি সাধারণ মুসলিম কাঠমিস্ত্রি গাজি ইলমুদ্দিন রাসুলের মহব্বতে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করে সবুজ পাখির ভেতর প্রবিষ্ট হয়ে জান্নাতে বিচরণ করার সৌভাগ্য লাভ করে।

ফাঁসি কার্যকর করার পর সেখানেই জানাজা ছাড়া গাজি ইলমুদ্দিনকে দাফন করা হয়।  এদিকে তার শাহাদাতের খবর দাবানলের মতো সারা হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। শহিদের লাশ তার ওসিয়ত মোতাবেক লাহোরে দাফন করার দাবিতে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। মুসলমানরা আল্লামা ইকবালের নেতৃত্বে বরকত আলী মোহামেডান হলে সমাবেশ ঘোষণা করে। ৫ নভেম্বর আল্লামা ইকবাল, স্যার মুহাম্মাদ শফি, মিয়াঁ আব্দুল আজিজ, মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দিন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ গভর্নরের সাথে সাক্ষাৎ করে সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে শহিদের লাশ সমর্পণের জন্য আবেদন করেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে ইংরেজ সরকার শাহাদাতের ১৪ দিন পর মুসলমানদের কাছে শহিদের লাশ অর্পণ করে। শহিদের লাশ কবর থেকে উঠিয়ে ট্রেনে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্ভরযোগ্য বর্ণনা অনুসারে গাজি ইলমুদ্দিনের জানাযায় ছয় লক্ষ মুসলমান অংশগ্রহণ করে। লাহোরের ভাটিচক থেকে শুরু করে সুমনাবাদ পর্যন্ত পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। জানাজা শেষে আল্লামা ইকবাল এবং সায়্যিদ দিদার আলী শাহ নিজ হাতে শহিদের লাশ কবরে রাখেন। যখন তার লাশ কবরে রাখা হচ্ছিল, তখন মাওলানা যফর আলী খান চিৎকার করে বলে ওঠেন, “হায়! আজ এই মর্যাদা যদি আমার নসিবে জোটতো!” ঠিক সেই মুহূর্তেই আল্লামা ইকবালের জবান থেকে উচ্চারিত হয়, ‘আমরা পরিকল্পনাই বানাতে থাকি আর এক কাঠমিস্ত্রির ছেলে এসে মর্যাদা লুফে নিয়ে যায়।’

১৪ দিন পরেও শহিদের লাশের কিছুই হয়নি

ব্রিটিশ সরকার জানাজা ছাড়াই তাঁকে দাফন করে। আল্লামা ইকবাল, মইন আব্দুল আজীজ প্রমুখ মুসলিম নেতারা প্রতিবাদ করেন। করাচির লোকেরাও তাকে করাচিতে ফেরত চাইতে থাকে। অবস্থা অবনতির দিকে গেলে ব্রিটশ সরকার লাশ উত্তোলনের অনুমতি দেয়। ১৪ দিন পর লাশ উত্তোলন করা হয়- অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল তাঁর দেহে না পঁচন ধরেছিল, না দুর্গন্ধ ছিল, না তাঁর কাপড়েও কোনও পরিবর্তন ঘটেছিল। দুই দিন পরে লাশ লাহোর পৌঁছায়। পথে লাখ লাখ লোক তাকে শ্রদ্ধা জানায়। লাহোরে দুই লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে জানাজা হয়।

ইলমুদ্দিনের বাবা আল্লামা ইকবালকে জানাজা পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জবাব দেন, ‘আমার মত গোনাহগার গাজী ইলমুদ্দিন শহীদের জানাজা পড়ানোর যোগ্য নয়।’ ইলমুদ্দিনের জানাজা পড়ান মসজিদ ওয়াজির আলি খানের ইমাম মাওলানা জাফর আলি খান।
পাকিস্তান জুড়ে অসংখ্য স্থাপনা, পার্ক, রাস্তা, হাসপাতাল, প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে তাঁর নামে। তাঁর মাজার জিয়ারত লাহোরজুড়ে এখনো অন্যতম আকর্ষণ। আল্লামা ইকবালসহ অসংখ্য কবি তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেন। পুস্তকও লেখা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। এখনো মানুষ গভীর শ্রদ্ধার সাথে তার এই নবীপ্রেমের নজরানাকে স্মরণ করে।

আল্লাহতায়ালা গজী ইলমুদ্দিনের এই নবীপ্রেম এবং বীরত্বগাঁথা শাহাদতকে কবুল করুন। নবীপ্রেমে আশেক হয়ে আমরাও যেন নবীর উজ্জত রক্ষা করতে পারি  আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন।