মওলানা রুমির মসনবি শরিফের গল্প-৫/২১৯
প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:১০ | অনলাইন সংস্করণ
ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
এক লোক বলছিল, জগৎটা কত সুন্দর হত যদি এখানে মৃত্যুর প্রশ্ন না থাকত। তার কথা শুনে আরেকজন বলল, মৃত্যু যদি না থাকত, এই জগৎ ও জীবন ঘাসপাতার চেয়েও অধম হত। তখন জগতে তোমার অবস্থা হত পরিত্যক্ত খড়স্ত‚পের মতো। খড় যতক্ষণ মাড়াই করা না হয়, ধান-গম খড়ের সাথে একাকার থাকে। মৃত্যুই মানুষের রূহকে দেহ থেকে আলাদা করে। মৃত্যুর মাড়াই হলেই কে ভালো বা মন্দ পরীক্ষিত হয়।
কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, “তিনি সেই সত্তা যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মধ্যে কে কর্মে উত্তম তা পরীক্ষা করার জন্য। তিনিই পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল।” (সুরা মুলক : আয়াত : ২)। কাজেই মৃত্যুকে তারাই অপছন্দকরে, যাদের দূরদৃষ্টি নাই।
সৃষ্টিলোকের ব্যবস্থাপনার দিকে গভীরভাবে তাকালে বুঝা যায়, এখানে যত পরিবর্তন-বিবর্তন আসে তা মৃত্যু ও বিনাশের পর পুনরায় জীবন লাভের চলমান প্রক্রিয়ামাত্র। ভাঙার পর গড়ার প্রক্রিয়া না থাকলে জীবনে পূর্ণতা আসত না। তাই জগত ও জীবনের পূর্ণতা ও উন্নতির জন্য মৃত্যু ও ধ্বংস অপরিহার্য।
মওলানা বলেন, পৃথিবীতে দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত যে জীবন তা আসলে মৃত্যু। এই মৃত্যুকে তুমি জীবন মনে করে ধোঁকায় পড়ে আছ। আর প্রকৃত জীবনকে মনে কর মরণ। এটি তোমার মিথ্যাবুদ্ধির প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। মওলানা এখন আল্লাহর কাছে পানাহ চান, এমন বুদ্ধির খপ্পড় থেকে। প্রভুহে! দুনিয়ার প্রতারণাকে তার স্বরূপে আমাকে দেখাও। হাদীসের ভাষায় দোয়াটির ভাষ্য, ‘প্রভুহে! সত্যকে আমায় সত্য হিসেবে দেখাও আর তাকে অনুসরণ করার তওফীক দাও এবং মিথ্যাকে দেখাও মিথ্যা রূপে আর তা থেকে বেঁচে থাকার তওফীক আমাকে দাও।’
তাই যারা মৃত্যু বরণ করেছে তারা প্রকৃত জীবনের আঙ্গিনায় চলে গেছে। এ কারণে তাদের কেউই মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে না; বরং তাদের আফসোস হল, হায়! যদি আবার দুনিয়াতে ফিরে যেতে পারতাম আর এই স্থায়ী জগতের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করে আনতে পারতাম। তাদের অনুভূতি হলো, দুনিয়ায় যতদিন ছিলাম বদ্ধ কুয়ায় আবদ্ধ ছিলাম, সেখান থেকে উদ্ধার পেয়ে এখন উপভোগ করছি বিশাল উন্মুক্ত ময়দানের আলোবাতাস। মায়ের গর্ভে মানব শিশু ভাবে, মায়ের উদরই আমার সুখের জগত। তবে জন্মের পর বুঝতে পারে সংকীর্ণ মাতৃগর্ভের বন্দিদশা ছেড়ে এক বিশাল বিচিত্র জগতে বিচরণরত। মৃত্যুর পর মানুষও বুঝতে পারবে, আল্লাহর সন্নিধানে আসন লাভের যে ওয়াদা দেয়া হয়েছে কোরআনে তা কিছুমাত্র অবাস্তব বা মিথ্যা নয়। সেখানকার চিরন্তন সুখ ও সৌভাগ্য চাইলে এখন থেকেই জীবনকে সাজাতে হবে। যদি এ ধরনের প্রস্তুতি তোমার এখনও না থাকে, আজকেই সিদ্ধান্ত নাও, অন্তত দু’একটি পদক্ষেপ গ্রহণ কর। হাদিসে এসেছে, কিয়ামতের দিন প্রত্যেকের প্রতি আদেশ হবে,
নাফখে সূর আমর আস্ত আয য়াযদা’নে পাক
কে বর আ’রীদ আই যরা’য়ের সার যে খা’ক
শিঙ্গায় ফুঁক সে তো আল্লাহর তরফে আদেশ
মাটি ফুঁড়ে উঠো আদম সন্তানরা ছাড় এ দেশ।
বা’য আয়াদ জা’নে হারয়্যক দর বদন
হামচো ওয়াক্তে সুবহ হুশ আয়দ বে তন
সেই আহŸানে প্রত্যেক প্রাণ ফিরে আসবে যার যার দেহে
নিদ্রা শেষে ভোরে হুঁশজ্ঞান ফিরে দেহের খাঁচায় যেভাবে।
মানুষ মারা যায়। তার মানে প্রাণ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কবর জীবনে ও হাশর ময়দানে প্রাণ পুনরায় দেহে ফিরে আসে। তখন দুনিয়াতে কে ভালো বা মন্দ কাজ করেছিল তার চুলচেরা হিসাব হবে। এর নাম হাশর। মওলানা হাশরের দিন বা পরকালের বাস্তবতার পক্ষে কয়েকটি দলিল দিচ্ছেন আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে। আমরা রাতে ঘুমাই। তখন আমাদের প্রাণ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বপ্নের ভুবনে উড়তে থাকে। ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙে প্রাণ আবার ফিরে আসে দেহের গৃহে। তখন আমরা জেগে উঠি, কর্মচঞ্চল হই।
মওলানা বলেন, তোমার ঘুমের কথা চিন্তা কর। ভোরবেলা যখন জাগ্রত হও, তোমার প্রাণ ফিরে আসে দেহের কুঠিরে। প্রতিটি প্রাণ তার নির্দিষ্ট দেহ ঠিকই চেনে। স্বর্ণকারের প্রাণ কখনো ভুলে দরজির দেহে যায় না। আলেমের প্রাণ কখনো ভুল করে জালেমের দেহে প্রবেশ করে না। প্রাণকে এই জ্ঞান দিয়েছেন মহান আল্লাহ তাআলা। এই উপমা থেকে হাশর এর বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা কর।
সুবহ হাশরে কুচাক আস্ত আই মুস্তাজীর
হাশরে আকবর রা’ কিয়াস আয ওয়েই বেগীর
ভোরের জাগরণ ছোট্ট হাশর, হে আশ্রয় সন্ধানী
বড় হাশরের পুনঃ জীবন লাভ অনুমান কর তেমনি।
রাতের সাময়িক বিচ্ছিন্নতার পর প্রাণ ভোরবেলা পুনরায় দেহের খাঁচায় ফিরে আসে। একে ছোট হাশর বল। মৃত্যুর সময় প্রাণ বিচ্ছিন্ন হয়ে হাশরে পুনরায় উড়ে এসে তোমার দেহের সাথে যুক্ত হবে। একে বল বড় হাশর। প্রাণের এই ফেরার মতো প্রত্যেকের আমলনামাও উড়ে উড়ে আসবে প্রত্যেকের ডান বাম হাতে। দুনিয়াতে প্রত্যেকের কথা, কাজ বা স্বভাবের ভালো নিখুঁত বিবরণী এই আমলনামা। টেপ রেকর্ডার বা সিসি ক্যামেরার মতো সবকিছু রেকর্ড হচ্ছে আমাদের কাঁধে স্থাপিত ক্যামেরায়। দুজন ফেরেশতা গোপনে এই কাজে নিয়োজিত। হাশরের ময়দানে এই গোপন ফাইল উন্মুচিত হবে। আর তা উড়ে উড়ে প্রত্যেকের ডান বা বাম হাতে এসে পড়বে।
“তখন যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেওয়া হবে সে (পরম খুশিতে) বলবে, আমার আমলনামা পড়ে দেখ।”(সুরা হাক্কা, আয়াত : ১৯)। “কিন্তু যার আমলনামা তার বাম হাতে দেওয়া হবে সে (চরম হতাশায়) বলবে, হায়! আমাকে যদি আমার আমলনামা দেওয়াই না হত।” (সুরা হাক্কা : ২৫)।
কৃপণতা বা দানশীলতা, তাকওয়া বা পাপাচার জীবন ভরের সব কাজের হিসাবের খাতা উড়ে আসবে প্রত্যেকের কাছে। যদি তুমি তোমার স্বভাবকে শুদ্ধ করে থাক জাগ্রত হওয়ার পর সেই অবস্থাই তোমার সম্মুখে আসবে। আর যদি গোমরাহি, মন্দ কাজ ও স্বভাবের মধ্যে জীবন কাটিয়ে থাক তার লিপি তুমি বাম হাতে পাবে। মওলানা আরো বলেন, আমাদের ঘুম ছোট মৃত্যু আর জেগে উঠা ছোট হাশর। এই ছোটকে দিয়ে বড় মৃত্যু ও বড় হাশরকে উপলব্ধি কর। এখানে তোমার কর্মলিপি গোপন থাকে; কিন্তু সেখানে প্রকাশিত হবে। কম্পিউটারের মেমোরিতে তথ্যগুলো অদৃশ্য থাকে; কিন্তু প্রিন্ট নিলে প্রকাশিত হয়। আমাদের আমলনামাও এখানে কল্পনার মতো অদৃশ্য। সেখানে তা প্রকাশ পাবে আকৃতিতে। বিষয়টা বুঝার জন্য একটি উপমা নাও। নির্মাণশিল্পী বাড়ি নির্মাণের আগে মনের আয়নায় ছক আঁঁকে। সে ছক দেখা যায় না। পরে যখন গৃহ নির্মাণ করে মনের কল্পিত ছকটিই বাস্তবে আকার ধারণ করে। দুনিয়াতে কৃতকর্মের ফিরিস্তি মনের কল্পনার মতো অদৃশ্য। এটি মাটির ভেতরে বুনে রাখা দানার মতো। শীতকালে এসব দানা প্রাণহীন ‘নাই’ এর মতো হয়ে থাকে। যখন বসন্ত আসে, সূর্যের ত্যেজে বরফ গলে যায়, অদৃশ্য দানাগুলো বিকশিত হয় পত্রপল্লবে। কিয়ামতের দিনের সূর্যও যখন উত্তাপ ছড়াবে মাটির মাঝে লুকায়িত দানার মতো আমাদের আমলনামা উদ্গত হবে। তখন বুঝা যাবে কোনটি সুন্দর সঠিক, কোনটি মন্দ কুৎসিত।
পরকালের বসন্তে গজিয়ে উঠা কিছু উদ্ভিদ প্রাণবন্ত সজিব মুত্তাকী আর কিছু হবে শির অবনত, অপদস্থ, তারা অপরাধী।
কোরআন মাজিদের ভাষায়, “হায় তুমি যদি দেখতে! যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে অধোবদন হয়ে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ও শ্রবণ কররাম, এখন তুমি আমাদেরকে পুনরায় প্রেরণ কর। আমরা সৎকর্ম করব, আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী।” (সুরাসাজদা, আয়াত : ১২)।
ভয়ে আতঙ্কে তাদের চোখগুলো বিস্ফোরিত। আমলনামা বাম হাতে আসে নাকি সে আশঙ্কায় কম্পিত। এমন সময় একটি ব্যতিক্রমী ঘটনায় হাশরের মাঠের পরিবেশ আবেগে আপ্লুত হল। এক গোনাহগার বান্দাকে হাজির করা হল, যার আমলনামায় কোনো ভালো কাজ নাই। যত অপকর্মে আকীর্ণ তার আমলনামা। আমলনামা উড়ে বামহাতে আসাতে সে বুঝতে পারে, দোযখই তার শেষ ঠিকানা। ভয়ে আতঙ্কে তার মুখে রা নেই। সৎকাজের কোনো চিহ্ণ যে নেই তার আমলের খাতায়। ধোঁকাবাজি, পাপ-অনাচার, অবহেলা আমিত্বের অহমিকায় কলুষিত জীবন কলুষিত। নিজের অপকর্মের পক্ষে এতকাল সাফাই গেয়ে বেড়াত, নানা কথা আওড়াত। সেসব সাফাই আজ পেরেক হয়ে তার দুই ওষ্ঠ চেপে ধরেছে। চোর যেন হাতেনাতে পাকড়াও।
ফেরেশতারা গোয়েন্দা পুলিশের মতো দুনিয়াতে গোপনে তাকে নজরদারিতে রেখেছিল। আজ তারা স্বশরীরে তার আগে পিছে পাহারায় নিয়োজিত। ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে চোর ডাকাত জেলহাজতে নেয়ার মতো হতভাগাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দোযখের দিকে। কিন্তু দোযখের পথে সে ঠেক ধরে। এত পা এগোয় তো দুইপা পিছায়। ফেরেশতারা গলাধাক্কা দেয়, হাঁকায়। আর সে বারবার পেছনে তাকায়। তার দুই চোখে অশ্রæর বন্যা। অনুতাপের বেদনায় কলিজা ধরপড় করে । কারো বৃথা আশায় বুকটা মোছড় দিয়ে উঠে। মুখে কিছু বলে না, চোখের চাহনীতে হাজারো অব্যক্ত বেদনা।
মহান আরশের মালিকের কাছ থেকে তখন আদেশ আসে, দেখ তো এই ছন্নছাড়ার এই দশা কেন? কেন সে বারবার পেছনে তাকায়? তার আমলনামায় তো কোনো সৎকর্ম নাই। রাতজাগা ইবাদত বা দানশীলতার কোনো চিহ্ণ নাই। তাকে দোযখেই যেতে হবে, এ কথা সে জানে। এরপরও কেন সে যেতে চায় না, গো ধরেছে? ফেরেশতারা তদন্ত শেষে তার কথাগুলো মহামহিমকে অবহিত করলেন।
বন্দা গুয়াদ আনচে ফরমূদী বয়া’ন
সদ চুনানম সদ চুনানাম চদ চুনা’ন
বন্দা বলছে, তুমি যা বলেছ সত্য প্রভুহে আমি
একশগুণ বেশি শতগুণ পাপী তার চেয়েও আমি।
কিন্তু তুমিই তো আমার নিকৃষ্টতম পাপগুলো গোপন রেখেছ। তুমি ‘সাত্তার’ দোষ গোপনকারী হয়ে আমার অপরাধ ঢেকে রেখেছ। আমার আমলনামায় কী লেখা, আমি জানি না, বুঝি না। কুফরী ও ঈমান নিয়ে কখনো ভাবি নি, কল্যাণ-অকল্যান চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। এতকিছুর পরও আজ তোমার দয়ার পরশ পাওয়ার আমায় আমার বুকটা আকুল হয়েছে। তোমার দয়া তো কোনো কিছুর বিনিময় স্বরূপ নয়। আমি চাইনি, আমার কোনো যোগ্যতা ছিল না, তারপরও তোমার অজ¯্র দয়াদানে ভরে দিয়েছ আমাকে। দুনিয়ায় তো আমি চেয়ে আসি নি। তোমার অপার অনুগ্রহে জীবন দিয়েছ, লালন করেছ । আজ আখেরাতে এসে এমন দুর্গতি। বারবার তাকাচ্ছি তোমার দয়ার সাগরে ঢেউ আসে কিনা।
বান্দা যখন তার গুনাহ-খাতা গণনা করে, লজ্জিত-অনুতাপ্ত হয় তখন আল্লাহর দয়ার সাগরে বান আসে। আল্লাহ পাক তখনই বললেন,
কাই মালায়েক বা’য আরীদাশ বে মা
কে বুদাস্তাশ চশমে দেল সূয়ে রাজা’
হে ফেরেশতারা তাকে নিয়ে এসো আমার কাছে
সে আশায় বুক বেঁধেছে আমার মাগফেরাত পাবে।
আমি কারো পরোয়া করি না, আমার বান্দাকে আমি মাফ করে দিলাম। তার সব পাপের উপর লালরেখা টেনে দিলাম। আমার রহমতের বরিষণে তার দিলের জমিনে বসন্তের সমারোহ জাগবে। তাকে নিয়ে যাও জান্নাতে।