গৌরবময় বিজয় দিবস আগামীকাল 

প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:২২ | অনলাইন সংস্করণ

  তৌফিক সুলতান

আগামীকাল সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন ১৬ ডিসেম্বর। আজ আত্মপ্রকাশ করার দিন বীরের জাতি হিসেবে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের সাথে বিশ্বকে আবার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দিন। এবার বিজয় দিবসকে উৎসবমুখর করতে সারা দেশে বিজয় মেলার আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম। 

বিজয় দিবস আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের সর্বত্র পালন করা হয়। প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর আমাদের দেশে  বিশেষভাবে পালিত হয়। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে দিনটিকে বাংলাদেশের জাতীয়দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয় এবং সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৯১,৬৩৪ সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

এ উপলক্ষে প্রতি বছর আমাদের দেশে দিবসটি যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য এবং বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পালিত হয়ে আসছে। বিগত দিনগুলোতে ১৬ ডিসেম্বর ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের সূচনা ঘটে আসছে। জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত সামরিক কুচকাওয়াজে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর সদস্যরা যোগ দিতে দেখা যায়। কুচকাওয়াজের অংশ হিসেবে সালাম গ্রহণ করেন আমাদের রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রী। যদিও এইবার প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর ভ‚মিকায় থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই কুচকাওয়াজ দেখার জন্য প্রচুরসংখ্যক মানুষ জড়ো হয়। আশাকরি এবারও থাকবে কিছু নতুনত্ব যা মানুষের হৃদয়কে বিমোহিত করবে।
১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিজয় দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কবিতা, নিবন্ধ, গণমাধ্যম ইত্যাদিতে বিভিন্নভাবে এই বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়। এই দিন উপলক্ষে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের আয়োজন করে থাকে।

এছাড়া, দেশের প্রতিটি উপজেলায় বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ, বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান, মতবিনিময় সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। দেশের মাদরাসাগুলোতে দেশের জন্য জীবনদানকারী বীর শহিদদের স্মরণসভা করা হয়। তাদের আত্মার মাগফেরাতের জন্য কোরআন পাঠ করে দোয়া করা হয়। এ ছাড়া এ দিনটিতে দেশের প্রধান সড়কগুলো জাতীয় পতাকা দিয়ে সাজানো হয়।

এ দিনে ঢাকার সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অংশ হিসেবে ঢাকার সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে থাকে। এ নিয়মটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের একটি প্রচলিত রীতি বটে, তবে ইসলামি বিধান মতে এ রীতিটা পালনীয় নয়, বরং বর্জনীয়। কারণ এতে শহিদদের কোনো উপকার হয় না। রীতিটাও ইসলাম সমর্থিত রীতি নয়।

ইসলাম মতে, বীর মুজাহিদদের কিংবা রাষ্ট্রীয় শহিদদের বীরত্বগাঁথা, অবদান ও আত্মত্যাগের স্মৃতিচারণমূলক স্মরণসভা হতে পারে। তাদের আত্মার মাগফেরাত ও পরকালীন জীবনের সফলতার জন্য কোরআন তিলাওয়াত ও দোয়ামাহফিলের আয়োজন করা যেতে পারে। শহিদদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এক মিনিটের নীরবতা পালন করাতে শহিদদের কোনো উপকার হয় না, বরং যারা এ নীরবতাকে সংস্কৃতিতে রূপান্তর করেছে তাদের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ, রাজনৈতিক নেতাকর্মীগণ কিংবা সাধারণ মানুষ যারাই শহিদদের কবরের পাশে গিয়ে ফুল দিয়ে আসেন, তাদের উচিত অন্তত একবার সুরা ফাতিহা ও তিনবার সুরা ইখলাস পাঠ করে শহিদদের জন্য প্রার্থনা করা। যে দেশের সংবিধানে বিসমিল্লাহ আছে, আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও ভরসার কথা উল্লেখ আছে, যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম সে দেশের রাষ্ট্রীয় একটি সংস্কৃতি অন্য ধর্মের রীতি অনুসারে হওয়া নিজেদের ধর্মীয় উদাসীনতা এবং নিজ দেশের সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ বহন করে। যা নিতান্তই বেদনার ও আফসোসের। 

১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেদিন ঢাকার কেন্দ্রস্থলে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন জেনারেল আমির আবদুল¬াহ খান নিয়াজি। তিনি যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ও ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার উপস্থিত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে উপস্থিত রাখা হয়নি। অনেকের ভাষ্যমতে ভারত সরকারের বাধার কারণে জেনারেল ওসমানী আতœসমর্পন অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন। আত্মসমর্পণ দলিলের ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ :

পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে।

এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চ‚ড়ান্ত। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেওয়া হবে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নয় মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং বাংলাদেশ (পরবর্তীকালে একটি শব্দ হিসাবে ব্যবহার শুরু করা হয়) নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত প্রায় সকল দেশ স্বাধীনতার মাসে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরই প্রেক্ষিতে, ১৯৭১: স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৯৭২: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংবিধান প্রকাশিত হয়। ১৯৭২: ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গ্যাজেটের মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় খেতাব ঘোষণা করা হয়।