ঢাকা ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আপসহীন নেতৃত্বের পথিকৃৎ মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহ.

আপসহীন নেতৃত্বের পথিকৃৎ মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহ.

মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী; বাংলার মাদানি খ্যাত বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন। অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করেননি তিনি। তার নেতৃত্ব ছিল আপসহীন। তিনি ছিলেন দেওবন্দি চেতনার ধারকবাহক বাংলাদেশি এক পথিকৃৎ আলেম, ইসলামি পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও ধর্মীয় বক্তা। তিনি যেমন থাকতেন সাদাশুভ্র পোশাক পরিহিত তেমন তার হৃদয়মনও ছিল সাদাশুভ্রতায় অনন্য। তিনি ক্ষুদ্র এক জীবনে বহু দ্বীনি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

তিনি ছিলেন একাধারে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব, আল হাইআতুল উলয়ার কো-চেয়ারম্যান, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা ও জামিয়া সোবহানিয়া মাহমুদ নগরের শায়খুল হাদিস ও মহাপরিচালক ছিলেন। হেফাজত আন্দোলন, খতমে নবুয়ত আন্দোলনসহ প্রভৃতি আন্দোলনে তিনি নেতৃস্থানীয় ভ‚মিকা পালন করেছিলেন এবং ইসলামি নেতা হিসেবে মুসলিম জনসাধারণের মাঝে তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল। এছাড়াও তিনি প্রায় ৪৫টি মাদ্রাসা পরিচালনার কাজে যুক্ত ছিলেন। শেষ বয়সে হুইল চেয়ারে বসে ধর্মীয় বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তিনি আমরণ অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। এ একটি গুণ তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা আসনে সমাসীন করেছিল।

শিক্ষা ও বেড়ে ওঠা : মাওলানা নূর হোসাই কাসেমী ১৯৪৫ সালের ১০ জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ থানার চড্ডা নামক গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল ওয়াদুদ। বাড়ির পার্শ্ববর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে তার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। এখানে চতুর্থ শ্রেণি শেষ করে চড্ডার কাশিপুর কাশেমুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর ভর্তি হন বরুড়ার আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসায়। এখানে হেদায়া জামাত (স্নাতক ১ম বর্ষ) পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে পড়ার উদ্দেশ্যে ভারতে গমন করেন। নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে না পেরে ভর্তি হন ভারতের সাহারানপুর জেলার বেড়ীতাজপুর মাদ্রাসায়। এখানে জামাতে জালালাইন (স্নাতক ২য় বর্ষ) সমাপ্তির পর দারুল উলুম দেওবন্দে চলে যান। দেওবন্দ মাদ্রাসায় তার অধ্যয়নকাল মোট ৩ বছর। এখানে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সমাপ্তির পর আরবি সাহিত্য ও দর্শনে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন। তার শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে: মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী, আনজার শাহ কাশ্মীরি, ফখরুদ্দীন আহমদ মুরাদাবাদী, মুহাম্মদ সালেম কাসেমি, তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জীসহ প্রমুখ খ্যাতিমান ব্যক্তি।

কর্মজীবন : তিনি কর্মজীবনে ভারতের মুযাফফরনগর জেলায় অবস্থিত মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মুরাদিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে ১ বছর শিক্ষকতার পর ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার নন্দনসার মুহিউস সুন্নাহ মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস ও মুহতামিম পদে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ঢাকার জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় চলে যান। এখানে তিনি ৪ বছর শিক্ষকতা করেছেন এবং ছাত্রাবাস পরিচালক ছিলেন। ১৯৮২ সালে তিনি কাজী মুতাসিম বিল¬াহ প্রতিষ্ঠিত জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে চলে আসেন। এখানে তার অধ্যাপনাকাল মোট ৬ বছর।

এরপর ১৯৮৮ সালে তিনি জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা এবং ১৯৯৮ সালে জামিয়া সোবহানিয়া মাহমুদ নগর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের শায়খুল হাদিস ও মহাপরিচালক ছিলেন। এছাড়াও তিনি প্রায় ৪৫টি মাদ্রাসা পরিচালনার কাজে যুক্ত ছিলেন।

২০২০ সালের ৩ অক্টোবর তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। আইন অনুসারে একই সাথে তিনি আল হাইআতুল উলয়ার কো-চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব নির্বাচিত হন। এর পূর্বে তিনি হেফাজতের ঢাকা মহানগরীর সভাপতি ছিলেন। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি খতমে নবুয়ত আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

রাজনীতি : ১৯৭৫ সালে তিনি জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৯০ সালে তিনি জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসেন এবং ৭ নভেম্বর ২০১৫ সালে তিনি এর মহাসচিবের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৩ ডিসেম্বর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। তিনি মহাসচিবের দায়িত্ব নেয়ার পর দেশব্যাপী সংগঠন বিস্তৃত লাভ করে। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী মহাসচিব ছিলেন তিনি। তিনি হেফাজতের মহাসচিব থাকাকালীন ঢাকায় ইসলাম বিরোধী সংগ্রাম, সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল ছিল সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত ও প্রভাববিস্তারক। এমনটাই বিজ্ঞজনরা মনে করে থাকেন।

তাসাউফ : ভারতের মুরাদিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনাকালে তিনি মুহাম্মদ জাকারিয়া কান্ধলভির কাছে বাইআত গ্রহণ করেন। তার মৃত্যুর পর তিনি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহীর নিকট বায়’আত হন এবং খেলাফত লাভ করেন। কাসেমীর খলিফা মোট ৭ জন। ১.মাওলানা ইছহাক, মানিকনগর ২. মাওলানা বশির আহমদ, সৈয়দপুর ৩. মাওলানা মাসউদুল করীম, দারুল উলূম টঙ্গী ৪. মাওলানা নোমান, হেমায়েতপুর ৫. মাওলানা আবুল খায়ের, জামিয়া সুবহানিয়া ৬. মাওলানা আবু হানীফা নোমান,মোমেনশাহী ৭. মাওলানা জালালুদ্দিন হক্কানী, সিলেটর)। [২]

পরিবার : পারিবারিক জীবনে তিনি ২ ছেলে যুবায়ের হুসাইন ও জাবের কাসেমী এবং দুই মেয়ের জনক। তার ছোট ছেলে জাবের কাসেমী একজন ইসলামি পÐিত ও জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসার মুহাদ্দিস।

ভারতের হিন্দুত্ববাদের সমালোচনা : ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় অভিযুক্ত সব আসামিকে বেকসুর খালাস দেয় ভারতের বিশেষ আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে কাসেমী বলেন, ‘ভারতীয় আদালত উগ্র হিন্দুত্ববাদের পক্ষ নিয়ে সত্য, ন্যায়-ইনসাফ ও বাস্তবতার সঙ্গে শুধু তামাশাই করেনি, বরং মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনকে বৈধতা দিতে শুরু করেছে। এই রায়ে ভারতের বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়াই কেবল প্রমাণ করে না; বরং দেশটির বিচার বিভাগের ওপরও যে হিন্দুত্ববাদিরা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে সেটাও স্পষ্ট হয়েছে।’

মৃত্যু : ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন ছোট ছেলে জাবের কাসেমীর ইমামতিতে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে তারই প্রতিষ্ঠিত সোবহানিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাজার নামাজ জাতীয় ঈদগাহে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও সরকারি অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে তার জানাজা ছিল স্মরণকালের সেরা জানাজা। কয়েক লক্ষ মানুষ উপস্থিত ছিল তার জানাজায়। মৃত্যুকালে এ ক্ষণজন্মা আলেমের বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।

আপসহীন,পথিকৃৎ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত