অধুনা সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে দ্রব্যের স্বাভাবিক মূল্যের ওপর উপর্যুপরি সুদ যোগ করে দেওয়া হয়। দ্রব্যবিশেষের ওপর তিন থেকে চারবার পর্যন্ত, ক্ষেত্রবিশেষে তারও বেশি সুদ যোগ হয়। দেশের বস্ত্রশিল্পের কথাই ধরা যেতে পারে। এ শিল্পের তুলা আমদানির জন্য আমদানিকারক ব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের জন্য যে সুদ দেয়, তা যুক্ত হয় তুলার ওপর। ওই তুলা থেকে সুতা তৈরির সময় বস্ত্রকল যে ঋণ নেয়, তার সুদ যুক্ত হয় কাপড়ের ওপর। এরপর কাপড়ের পাইকারি বিক্রেতা তার ব্যবসার উদ্দেশে যে ঋণ নেয়, তার সুদও যোগ করে ওই কাপড় যখন খুচরা দোকানে আসে বা প্রকৃত ভোক্তা ক্রয় করে, তখন তাকে আসল মূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি করে দিতে হচ্ছে। এভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রতিটিতেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুদ জড়িয়ে আছে। নিরুপায় ভোক্তাকে বাধ্য হয়েই চড়ামূল্য দিতে হচ্ছে। আর সুদনির্ভর অর্থনীতিতে এ ছাড়া উপায় নেই। দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ এ অভিশপ্ত সুদ।
সুদের পরিণাম ভয়াবহ : সুদখোরদের কারণে খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। পর্যায়ক্রমে এসব পণ্য সংগ্রহ কঠিনতর হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের জন্য। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে অর্ধাহারে-অনাহারে কাটাতে বাধ্য করছে। সর্বসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে অশ্বের মতো দ্রæতগতিতে বেড়ে চলছে প্রতিটি পণ্যের মূল্য। তাই ব্যক্তি, সমাজ ও অর্থনীতিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সুদ বর্জন করতে হবে। কোরআন ও হাদিসে সুদ খাওয়া, সুদ দেওয়া এবং সুদের সঙ্গে কোনোরূপ সংশ্লিষ্টতার কারণে পরকালে কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সুদ খায়, তারা (কেয়ামতের দিন) সেই ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, শয়তান যাকে স্পর্শ দ্বারা পাগল বানিয়েছে। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। যার কাছে তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে এবং সে (সুদি কারবার হতে) বিরত হয়েছে, তবে অতীতে যা হয়েছে, তা তারই। আর তার (অভ্যন্তরীণ অবস্থার) ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় (সে কাজই) করবে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে। সেখানে তারা সর্বদা থাকবে।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)।
সুদ হালাল উপার্জনে বাধা : সুদ একটি ভয়াবহ ব্যাধি। এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব সুদূর প্রসারী। এটি সামাজিক ও ব্যক্তি জীবনে মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনে। সুদি কারবারের ফলে সমাজে চারিত্রিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। পরিশুদ্ধ জীবনযাপনে অন্তরায় হয়। ঋণের পরিবর্তে যে অতিরিক্ত অর্থ চুক্তির ভিত্তিতে আদান-প্রদান করা হয়, তা-ই সুদ। চাই তা পরিমাণে কম হোক বা বেশি। প্রসিদ্ধ সাহাবি ফুজালা ইবনে উবাইদ (রা.) বলেন, ‘যে ঋণ লাভ টেনে আনে, তা সুদ।’ (আস সুনানুল কোবরা : ৫/৩৫০)। ‘সুদ’ করজে হাসানা বা ঋণের মতো মহৎ ও সওয়াবের পথ বন্ধ করে দেয়। হালাল উপার্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করে। সুদ অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ার। অন্যায়ভাবে সম্পদকে এক হাতে পুঞ্জীভ‚ত করার অপকৌশল।
সুদখোরের ওপর নবীজির লানত : সুদি কারবার ধনীদের দরিদ্র ও অসহায়দের সম্পদে বাড়তি ভাগ বাসানোর সুযোগ করে দেয়। কেননা, যে ব্যক্তি দশ টাকাকে বারো টাকায় নগদ কিংবা বাকিতে বিক্রি করে, সে অতিরিক্ত দুই টাকা কোনো প্রকার বিনিময় ছাড়া লাভ করল; যা অন্যায়, জুলুম। আর একজন মুসলমানের ধনসম্পদ তার রক্তের সমতুল্য। তাই হাদিসে সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, এর সাক্ষী ও লেখককে লানত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘যে সুদ খায়, যে সুদ দেয়, যে সাক্ষী থাকে এবং যে ব্যক্তি সুদের হিসাব-নিকাশ বা সুদের চুক্তিপত্র ইত্যাদি লিখে দেয়, তাদের ওপর রাসুল (সা.) লানত করেছেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৩৩৩)।
সুদ একটি ধ্বংসাত্মক কাজ : সুদকে রাসুল (সা.) ধ্বংসাত্মক কাজ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাক।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! সেই সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ কী?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, জাদু করা, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা (যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন), সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, জিহাদের ময়দান থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা এবং সতীসাধ্বী সরলমনা উদাসীনা মোমিন নারীর বিরুদ্ধে অপকর্মের মিথ্যা অপবাদ দেওয়া।’ (মুসলিম : ১২১)।
ইসলামি আইনে সুদ নিষিদ্ধ : রাসুল (সা.) সুদের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে শুধু নৈতিক বিবেচনার অধীনে রাখেননি, বরং আইনের মর্যাদা দিয়েছেন। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে সুদ পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ করে বলেছেন, ‘জাহেলি যুগের সুদব্যবস্থা রহিত করা হলো। এ পর্যায়ে সর্বপ্রথম আমি আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদ মাফ করে দিলাম। আর সেই সঙ্গে গোটা সুদব্যবস্থা আজ থেকে রহিত করা হলো।’ (মুসলিম : ১২১৮)। এ হাদিসে জাহেলি যুগের প্রচলিত রীতিগুলোকে রাসুল (সা.) বাতিল করেছেন।
সুদখোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা : সুদ খাওয়া আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে, তা ছেড়ে দাও; যদি তোমরা মোমিন হও। যদি না ছাড়, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও। আর যদি তোমরা তওবা করো, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। এতে তোমরা (কারও প্রতি) জুলুম করবে না এবং তোমাদের প্রতিও জুলুম করা হবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৭৮-২৭৯)।
সুদখোরের পরকালীন শাস্তি কঠোর : সুদখোরদের ভয়াবহ শাস্তির ব্যাপারে রাসুল (সা.) একবার বললেন, আজ রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি, দুই ব্যক্তি আমার কাছে আগমন করে আমাকে এক পবিত্র ভ‚মিতে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে এক রক্তের নদীর কাছে পৌঁছুলাম। নদীর মধ্যস্থলে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে, আরেকজন নদীর তীরে। তার সামনে পাথর পড়ে আছে। নদীর মাঝখানের লোকটি যখন বেরিয়ে আসতে চায়, তখন তীরের লোকটি তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করে তাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে যতবার সে বেরিয়ে আসতে চায়, ততবারই তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করছে, আর সে স্বস্থানে ফিরে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘লোকটি কে?’ জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘যাকে আপনি (রক্তের) নদীতে দেখেছেন, সে হলো সুদখোর।’ (বোখারি : ২০৮৫)।
সুদখোরের জন্য জান্নাত হারাম : রাসুল (সা.) বলেন, ‘চার ব্যক্তি এমন রয়েছে, যাদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা নিজের ওপর ওয়াজিব করে নিয়েছেন যে, তিনি তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না এবং জান্নাতের কোনো নেয়ামতও আস্বাদন করাবেন না। (তারা হলো) নিয়মিত মদ পানকারী, সুদখোর, অন্যায়ভাবে এতিমের মাল ভক্ষণকারী এবং বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান।’ (মুসতাদরাকে আলাস সহিহাইন লিল হাকেম : ২/৪৩)।