থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন ও ইসলাম

প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:১৪ | অনলাইন সংস্করণ

  মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

প্রাচীন পারস্যের পরাক্রমশালী সম্রাট জামশিদ খিষ্টপূর্ব ৮০০ সালে নববর্ষ প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে ব্যাবিলনের সম্রাট জুলিয়াস সিজার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ সালে ইংরেজি নববর্ষ প্রচলন করেন। প্রথমদিকে নববর্ষ বিভিন্ন তারিখে পালন করা হতো। পরবর্তীতে ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর পহেলা জানুয়ারিকে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। বাংলাদেশে থাটি ফার্স্ট নাইটের ব্যাপক প্রচলন ঘটে ২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতের মিলেনিয়াম বা সহস্রাব্দ পালনের মধ্য দিয়ে। এ রাতের ১২টা ১ মিনিটকে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ মুহূর্ত হিসেবে অভিহিত করা হয়।

থার্টি ফার্স্ট নাইট মুসলিম সভ্যতা নয় : বছরের শেষ রাতের মুহূর্তটি উদযাপন খ্রিষ্টিয় সংস্কৃতি। বিশ্বব্যাপী ইসলামি স্কলারগণ ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ উদযাপনকে হারাম বলেছেন। মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে এটি অপসংস্কৃতি। তাই একজন রুচিশীল ও সচেতন ঈমানদার মুসলমান কখনও থার্টি ফাস্ট নাইট সংস্কৃতি উদযাপন করতে পারে না। বিজাতীয় সংস্কৃতি উদযাপনে কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা এমনই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের অনুসরণ করবে, কখনও তার সেই আমল গ্রহণ করা হবে না। আর পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ৮৫)।

মুসলমান বিজাতীয় সংস্কৃতির সহযোগী নয় : থাটি ফার্স্ট নাইটে মুখে উচ্চারণ করে কিংবা ম্যাসেজের মাধ্যমে অভিবাদন জানানো, আতশবাজি, পটকাবাজি, ফ্যাশন শো, ট্যাটু বা উল্কা অঙ্কন, ডিজে পার্টি ও কনসার্ট, নেশা সেবনসহ বিজাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সাদৃশ্য রাখাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। বিজাতীয় সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণই নয়, বরং মুসলিমদের কোনো কাজে মুশরিকদের সাহায্যও গ্রহণ করতেন না নবীজি (সা.)। কারণ, প্রত্যেক জাতির জন্যই রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধান ও করণীয়। সে আলোকে মুসলিমদের জন্য রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রত্যেক জাতির জন্য আমি একটি নির্দিষ্ট বিধান এবং সুস্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।’ (সুরা মায়িদা : ৪৮)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করল, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৩৪৭)।

শিরকযুক্ত শ্লোগান কাম্য নয় : মুসলিমদের অনেকেই বর্ষবরণ করতে গিয়ে শিরকে লিপ্ত হয়ে ঈমানহারা হয়। এ রাতে তাদের শ্লোগান হচ্ছে, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা।’ এ শ্লোগানে অগ্নিপূজকদের আগুন দ্বারা পবিত্র হওয়ার ভ্রান্ত বিশ্বাস সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে। অথচ আগুনকে সম্মান করা, আগুনের কাছে সাহায্য চাওয়া এবং আগুন দ্বারা পবিত্র হওয়ার ধারণা করা শিরক। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শিরককারীকে ক্ষমা করবেন না।’ (সুরা নিসা : ১১৬)।

অনর্থক সময়ের অপচয় করা অনুচিত : পশ্চিমা সংস্কৃতি নামের অপসংস্কৃতি হচ্ছে কথিত থার্টি ফার্স্ট নাইট। যা মুসলিম সমাজে অসার, অনর্থক ও শয়তানি কাজ হিসেবে স্বীকৃত। আল্লাহতায়ালা এ ধরনের বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকতে মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই বিশ্বাসীরা সফলকাম হয়েছে, যারা নামাজে বিনয়ী-ন¤্র, যারা অসার ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকে।’ (সুরা মোমিনুন : ১-৩)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। যে কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তখন তো শয়তান নির্লজ্জতা ও মন্দ কাজেরই আদেশ করবে।’ (সুরা নুর : ২১)।

অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা অশোভনীয় : অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা ইসলামে গর্হিত ও নিকৃষ্টতম পাপাচার বলে গণ্য। থার্টি-ফার্স্ট নাইট উদযাপনের নামে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, সমুদ্র সৈকত ও নাইট ক্লাবে যুবক-যুবতীরা অবাধে মেলামেশা ও অপকর্মে লিপ্ত হয়; যা ইসলামের পরিভাষায় জিনা বা ব্যভিচার। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩২)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘মহান আল্লাহ যাবতীয় অশ্লীল ও অন্যায় কাজ হারাম করেছেন।’ (সুরা আরাফ : ৩২)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে সকল নারী পোশাক পরিহিতা, কিন্তু নগ্ন; যারা পরপুরুষকে আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও আকৃষ্ট হয়; তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধবিশিষ্ট উটের মতো; তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।’ (মুসলিম : ২১২৮)।

গান-বাজনা মোমিনের কাজ নয় : অশ্লীল গান-বাজনা ইসলামে নিষিদ্ধ। এ রাতে বর্ষবরণের নামে আয়োজিত হয় বিভিন্ন ধরনের অশ্লীল কনসার্ট। যেখানে নারী-পুরুষের একসঙ্গে গান-বাজনা, নগ্ননৃত্য আবশ্যকীয় বিষয়। অথচ আল্লাহতায়ালা ও রাসুল (সা.) এসব নিন্দনীয় কাজ সম্পূর্ণ হারাম ও অবৈধ ঘোষণা করেছেন। যারা এসব কাজে লিপ্ত হয়, তাদের জন্য কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘একশ্রেণির লোক আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট করার উদ্দেশে অন্ধভাবে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রæপ করে, এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ (সুরা লোকমান : ৬)।

আতশবাজি ও পটকাবাজি কল্যাণকর নয় : এ রাতে আনন্দ-উল্লাস করার জন্য মধ্য রাত থেকে শুরু হয় আতশবাজি ও পটকাবাজি; যা জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি করে। এর দ্বারা অগ্নিসংযোগেরও আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া এসব কর্মকাÐ জনসাধারণের জন্য কষ্টদায়ক ও বিরক্তিকর কারণ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা বিনা অপরাধে মোমিন নর-নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহজাব : ৫৮)।

অর্থ অপচয় ও অপব্যয় মোমিনের লক্ষণ নয় : এ রাতকে কেন্দ্র করে অনেক অর্থ অনৈসলামি ও হারাম কাজে ব্যয় করা হয়; যা একদিকে যেমন মারাত্মক গোনাহের কাজ, অপরদিকে অপচয় ও অপব্যয়। আর ইসলাম অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা পানাহার করো, কিন্তু অপচয় করো না। কেননা, আল্লাহতায়ালা অপচয়কারীদের পছন্দ করে না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তোমরা অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের বড়ই অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৭)।

নববর্ষ উদযাপনকারীর ব্যাপারে ধমক : যারা ইসলামের আওতায় নেই, নিঃসন্দেহে তারা কাফের-মুশরিকদের অন্তর্গত। তাই কাফের-মুশরিকদের অনুসরণও ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সমস্ত প্রাণীর মাঝে আল্লাহর কাছে কাফেররাই নিকৃষ্ট; যারা ঈমান আনেনি।’ (সুরা আনফাল : ৫৫)। তাই আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন, ‘হে মুসলিমগণ! তোমরা ওই জালেমদের দিকে একটুও ঝুঁকবে না। অন্যথায় জাহান্নামের আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে।’ (সুরা হুদ : ১১৩)।

প্রকৃত মুসলমানের করণীয় : মুসলমানের উৎসব ইবাদতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ বিষয়টি জানতে হলে ইসলামের সার্বিকতা বুঝতে হবে। ইসলাম কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়, বরং মানুষের গোটা জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী বিন্যস্ত ও সজ্জিত করতে উদ্যোগী হয়। তাই একজন মুসলিমের জন্য জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইবাদত। যেমনটি আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত : ৫৬)। সুতরাং মোমিন হিসেবে আমাদের কর্তব্য, থার্টি-ফার্স্ট নাইট উদযাপনসহ এ ধরনের সকল বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকা। কথিত বর্ষবরণ বা উৎসবের নামে সকল প্রকার অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, হৈ-হুল্লোড় এবং নগ্নতা প্রদর্শনকে এড়িয়ে চলা। কারণ, আল্লাহ মানুষকে জীবন-যৌবনের পূজা করার জন্য সৃষ্টি করেননি, বরং প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর একচ্ছত্র আনুগত্য করার জন্যই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আর মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীবের মর্যাদাও দেয়া হয়েছে। মূলত আমল বা কর্মের মাধ্যমেই মানুষকে তার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। মানুষকে সৎকাজের আদেশ, অসৎ এবং বেহুদাপনা থেকে বিরত রাখতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত; মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য তোমাদের পাঠানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১১০)।