একদিন মহিলা দাসীকে সাথে নিয়ে হাম্মামে গেল একটু দূরে। তখনকার দিনের হাম্মাম ছিল গণগোসলখানা দূরে লোকালয়ে। চুলে সাবান মাখতেই মহিলার মনে পড়ল, সাবান রাখার তশতরি ফেলে এসেছে বাড়িতে। দাসীকে বলল, এক দৌঁড়ে গিয়ে তশতরিটা নিয়ে আয় তাকের উপর হতে। কথাটি শোনামাত্র দাসীর মনে শিহরণ জাগল। তার দেহে যেন প্রাণের সঞ্চার হলো। এতদিনের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ বুঝি আজ এলো। হুযুর একা বাড়িতেই আছেন। দীর্ঘ ছয়টি বছর পর মনষ্কাম পূরণের আশায় দাসী বাতাসের বেগে ছুটল। ঘরে গিয়ে দরজায় ছিটকানির কথাও ভুলে গেল।
এদিকে হাম্মামে মহিলা চমকে উঠল, হায় কী করলাম। মাথার সাবানটা ধুয়ে ভিজা কাপড়ে রওনা দিল দৌঁড়ের গতিতে। মওলানার মূল্যায়ন হলো দাসীর দৌঁড় ছিল প্রেমের টানে আর মহিলার দৌঁড় ভয়ের কারণে।
এই কলামে আমরা একাধিকবার বলেছি, মসনবি শরিফে গল্প বলা মওলানার উদ্দেশ্য নয়; বরং গল্পের উপসংহারে মওলানা তার জীবনদর্শন তুলে ধরেন অথবা পাঠক শ্রোতাদের মনোযোগ ধরে রেখে আধ্যাত্মিক তত্ত¡দর্শন ব্যাখ্যা করেন। এখানেও তিনি গল্পের ধারাভাষ্যে বিরতি দিয়ে প্রেম ও ভয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন আধ্যাত্মিকতার উচ্চতায় নিয়ে।
সাইরে আরেফ হার দমী তা’ তখতে শাহ
সাইরে যাহেদ হার মাহী য়্যক রূযে রাহ
আরেফের সফর এক মুহূর্তে বাদশাহর সিংহাসনে
যাহেদ সফর করে এক দিনের পথ পুরো এক মাসে।আল্লাহর পরিচয় পেয়ে আল্লাহর প্রেমে আসক্ত বান্দার নাম আরেফ। যাহেদ মানে আনুষ্ঠানিক ইবাদত বন্দেগির মধ্যে যার সাধনা সীমিত। মওলানার ভাষায় ‘আরেফ’ আর ‘যাহেদ’ এর সাধনার মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। আরেফ প্রেমের ডানায় ভর করে একদিনে মহামহিম বাদশাহর দরবারে গিয়ে পৌঁছতে পারে; অথচ যাহেদ একমাস সাধনা করে মাত্র একদিনের পথ অতিক্রম করতে পারে। অবশ্য যাহেদের সাধনারও মূল্য আছে; তবে সে একদিনে পঞ্চাশ হাজার বছরের পথ অতিক্রম করতে পারে না, যা প্রেমিক আরেফের পক্ষে সম্ভব। আসলে যোগ্য দক্ষ মানুষের প্রতিটি দিন এই জগতের পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। একজন আরেফের জীবনের এক দিনের মূল্যও সেই লোকের চেয়ে পঞ্চাশ হাজার গুণ বেশি, যে লাভ ক্ষতির হিসাব মাথায় নিয়ে সাধনা করে। মওলানা আরো বলেন, এই রহস্য বুদ্ধির মাথায় ধরবে না। মানুষ যতই কল্পনা অনুমান করুক তার আওতায় এই হিসাব আসবে না। প্রেমের সামনে ভয়ের মূল্য একগাছি চুলের সমানও নয়। কারণ, পুরো সৃষ্টিলোক প্রেমের মধ্যেই মজে আছে।
তুমি বলতে পার, যে প্রেমের কথা বলা হচ্ছে তার আরবি প্রতিশব্দ এশক। অথচ কোরআন হাদিসে এশক শব্দটি আসেনি। এসেছে হুব্ব, মহব্বত। যার অর্থ ভালোবাসা। প্রেম ও ভালোবাসার ফারাক বুঝার জন্য এ কথাটি বুঝো যে, শাম বা সিরিয়া বলতে যা বুঝায় দামেস্ক শব্দের অর্থ তার চেয়ে ভিন্ন নয়।
এর মর্মার্থ বুঝতে হলে আরো একটু গভীরে যেতে হবে। তাহলো আল্লাহর প্রেমে ইবাদত আর দোযখের ভয় বা বেহেশতের লোভে ইবাদতের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। তাছাড়া হুব্ব বা মহব্বত আল্লাহর গুণ। কাজেই আল্লাহর মহব্বতের বান্দা আল্লাহর সেই গুণের ঝলকে আলোকিত হয়ে যায়। কিন্তু ভয় শুধু বান্দার গুণ। মহান আল্লাহর পবিত্র সত্তাকে ভয় স্পর্শ করতে পারে না। কাজেই ভয়ের চেয়ে প্রেমের মূল্য লক্ষকোটি গুণ বেশি।
চোন য়ুহিব্বুনা বেখান্দী দর নুবী
বা য়ুহিব্বুহুম করীন দর মতলবী
তারা ভালোবাসে যখন পড় কোরআনে
তিনি তাদের ভালোবাসেন দেখ সেখানে।
কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,“হে মোমেনগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ আল্লাহর দ্বীন হতে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন, যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন আর যারা তাদেরকে ভালোবাসবে।” (সুরা মায়েদা: ৫৪)।
মওলানা বলেন, আয়াতে বলা হয়েছে, বান্দারা আল্লাহকে ভালোবাসে। ওদিক থেকে আল্লাহও বান্দাদের ভালোবাসেন। কাজেই ভালোবাসা দ্বিপাক্ষিক। তবে কারো মনে যেন সন্দেহ না জাগে যে, বান্দা তাহলে কি আল্লাহর ভালোবাসা গুণের ধারক হতে পারবে? সত্য হলো উভয়ের ভালোবাসার মাঝখানে ব্যবধান আকাশ পাতাল। তুমি এসব নিয়ে তর্কে না জড়িয়ে চেষ্টা কর, যাতে আল্লাহর গুণের ঝলকে জীবনকে আলোকিত করতে পার। মওলানা আরো বলেন, আমি যদি প্রেমের বর্ণনা দিতে যাই তাহলে কেয়ামতকাণ্ড ঘটে গেলেও সে বর্ণনা শেষ হবে না। কারণ কেয়ামতেরও সীমারেখা আছে। এই দুনিয়া শেষ হলেই কেয়ামত শুরু হবে। তার মানে দুনিয়ারও সীমা আছে, কেয়ামতেরও সীমা আছে। কিন্তু আল্লাহর মহান সত্তা ও তার গুণাবলির সীমারেখা নাই। বিষয়টি অন্যভাবে বুঝো,
এশক রা’ পাঁনসদ পরাস্ত ও হার পরী
আয ফরা’যে আরশ তা তাহতাস সারী
প্রেমের আছে পাঁচশত ডানা, প্রতিটি ডানা
আরশ হতে পাতাল পরিব্যাপ্ত একটানা।
যাহেদে বা তারস মী তা’যদ বে পা
আশেকান পররা’নতর আয বারক ও হাওয়া
দ্বিধা সংকোচে যাহেদ চলে ভয়ে বিচলিত পায়ে
প্রেমিক উড়াল দেয় বায়ু বিদ্যুতের চেয়ে বেগে।যাদের পথ চলা দ্বিধা-সংকোচে কম্পিত তারা কীভাবে প্রেমের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারবে। প্রেম তো আসমানকেও পদানত করতে পারে নিজের আকর্ষণে। হ্যাঁ, যদি আল্লাহর দয়া যাহেদের প্রতি সহায় হয়, তাহলে সেও মুক্ত হতে পারবে জগতের বন্ধন হতে, তখন তার ধীরগতি বদলে যাবে।
মহিলা বাড়িতে এসে দরজায় ধাক্কা দিল। ঘরে প্রবেশ করে দেখে, দাসী বিমর্ষ দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক, স্থির চাহনি। আর স্বামীজি নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন, কিন্তু শরীরে কীসের যেন কাঁপুনি। মহিলার কাছে স্বামীর ভণ্ডামি পরিষ্কার। পরনের লুঙ্গিটা সরিয়ে দেখে হাঁটু তার নাপাক। মাথায় প্রচন্ড আঘাত করে মহিলা চেঁচিয়ে ওঠে, শয়তান! এভাবে বুযুর্গ সাজতে চাও। যে নামাজ মনের জীবনের নাপাকি দূর করে। সেই নামাজে তুমি দাঁড়িয়েছ মনের নাপাকি নিয়ে!
ধর্মের ছদ্মাবরণে ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন করে মওলানা বলেন, তোতার মতো মুখের বুলি দিয়ে ঈমান প্রমাণ হবে না। আনুষ্ঠানিকতার কসরতের নাম ইবাদত নয়। তোমার যদি ঈমান থাকে, যদি অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকে তার আলামত তোমার আচরণে প্রকাশ পেতে হবে। তোমার অন্তর কলুষিত, বিদ্বেষ, লোভ ও পাপে জীবন জর্জরিত, এরপরও ঈমানদার বলে দোহাই দিয়ে ভণ্ড তাপস সেজে তুমি রক্ষা পেতে চাও? তোমার মতো মুখের বুলি তো কাফের মুশরিকও উচ্চারণ করে; কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, তুমি যদি তাদেরকে (কাফের মুশরিকদের) জিজ্ঞাসা কর, এই জগতের স্রষ্টা কে? তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। (দ্র. সুরা আনকাবুত : ৬১) কিন্তু তাদের কুফরি, পাপাচার, পূজা-অর্চনা আর জুলুম ব্যভিচারের কলুষিত জীবনের সাথে কি এই স্বীকারুক্তির মিল আছে? তাদের কাজই সাক্ষ্য দেয় তাদের মুখের বুলি মিথ্যা। তাদের অপেক্ষায় আছে ভয়ানক আজাব। সেদিন তোমার মিথ্যা দাবি, ভণ্ডামি বুযুর্গির জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। সেদিন প্রত্যেকের হাত-পা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সাক্ষ্য দেবে নিজেদের বিরুদ্ধে,
দস্ত গূয়াদ মন চোনীন দুযদিদে আম
লব্ব গুয়াদ মন চোনীন পুরসিদে আম
হাত বলবে, আমি করেছি চুরি কারচুপি এমন এমন
মুখও স্বীকার করবে, বলেছি কুকথা মিথ্যাবচন।
পায় গূয়াদ মন শোদাস্তাম তা মিনা
ফুর্জ গূয়াদ মন বেকারদাস্তাম যেনা
পা বলবে আমি গেছি পাপের পথে তার নির্দেশে
লজ্জাস্থান বলবে, আমার বিচরণ ছিল নিষিদ্ধ গলিতে।
চাশম গূয়াদ কার্দে আম গামযেয় হারাম
গূশ গূয়াদ চীদে আম সূ-ঈল কালাম
চোখ বলবে, আমি হারামের প্রতি করেছি দৃষ্টিপাত
কান বলবে, হ্যাঁ, যত কথা শুনেছি খারাপ খারাপ।
পস দরুগ আমাদ যেসার তা পায়ে খেশ
কে দরুগাশ কর্দ হাম আ’যায়ে খেশ
এভাবে তার আপাদমস্তক সাক্ষ্য দেবে মিথ্যাচারের
কারণ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সে লালন করেছে মিথ্যার ছলে।
কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,“আমি আজ তাদের মুখ মোহর করে দেব, তাদের হাত কথা বলবে আমার সাথে এবং এদের পাগুলো সাক্ষ্য দেবে এদের কৃতকর্মের।” (সুরা ইয়াসীন: ৬৫)।
আনচুনানকে দর নামাযে বা’ ফুরুগ
আয গাওয়াহী খুসয়া শুদ রিযকাশ দরুগ
তাপসের হাঁটু নামাজে যেভাবে সাক্ষ্য দিয়েছে ভণ্ডামির
প্রতিটি অঙ্গ বলবে সেদিন, আমিই সাক্ষী এই পাপীর।হ্যাঁ, তোমার জীবন যদি কলুষিত হয় আর যদি বুঝতে পার, ভুলের মধ্যে নিমজ্জিত আছ, তাহলে আজকেই সিদ্ধান্ত নাও। এখনই তওবা কর। ফিরে এসো। মনে কর, তোমার জীবন একটি গাছ। শাখা প্রশাখা তোমার অতীতের যাপিত জীবন। কোনো অবস্থাতেই তুমি নিরাশ হয়ো না। হাতে যে সময় আছে তাকে কাজে লাগাও। মরা ডারপালা ঝেড়ে ফেল। গাছের শিকড়ে তওবার পানি ঢাল। তখন নতুন পত্রপল্লবের সমারোহ জাগবে। জীবন বদলে যাবে।
বীখে ওম্রত রা’ বেদেহ আবে হায়াত
তা’ দেরখতে ওম্র গর্দদ বা’ নবা’ত
তোমার জীবনের গোড়ায় ঢাল আব হায়াত
জীবন বৃক্ষে জাগুক তোমার সবুজের প্রভাত।তোমার অতীত বদলে যাবে সুন্দর ভবিষ্যতের আলোর ঝলকানিতে। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে “তবে তারা নয়, যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। আল্লাহ তাদের পাপ পরিবর্তন করে দেবেন পুণ্যের দ্বারা। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সুরা ফোরকান: ৭০)। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-২১৬৩-২২২৭)