শিশুদের প্রতি রাসুল (সা.)-এর গভীর ভালোবাসা ছিল। তিনি তাদের খুব আদর-স্নেহ করতেন। হাসিমুখে কথা বলতেন। কোমল আচরণে তাদের হৃদয় জয় করতেন। মায়া মমতার ক্ষেত্রে তিনি পৃথিবীতে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এ সংক্রান্ত পাঁচটি হাদিস উল্লেখ করা হলো।
শিশুদের আদর স্নেহ করা : রাসুলুল্লাহ (সা.) আদর করে শিশুদের চুম্বন করতেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় গুণ। কোমল হৃদয়ের পরিচায়ক। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক বেদুঈন রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললো, আপনারা শিশুদের চুম্বন করে থাকেন; কিন্তু আমরা ওদের চুম্বন করি না। রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে রহমত উঠিয়ে নেন, তবে আমি কি তোমার উপর (তা ফিরিয়ে দেওয়ার) অধিকার রাখি? (বোখারি, হাদিস : ৫৫৭২)।
শিশুদের খোঁজখবর নেওয়া : রাসুল (সা.) শিশুদের খোঁজখবর রাখতেন। তাদের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতেন। তাদের আনন্দ-দুঃখের প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন। আবু উমায়র এর একটি ছোট পাখির মৃত্যুতে তিনি তাকে সান্ত¡না দিয়েছিলেন। এটি শিশুর মনোবিকাশ এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) সবার চেয়ে বেশি সদাচারী ছিলেন। আমার একজন ভাই ছিল, তাকে আবু উমায়র বলে ডাকা হত।
আমার অনুমান যে, সে তখন মায়ের দুধ খেতো না। যখনই সে তার নিকট আসত, তিনি বলতেন, হে আবু উমায়র! তোমার নুগায়র কি করছে? সে নুগায়র পাখিটা নিয়ে খেলত। আর প্রায়ই যখন নামাজের সময় হত, আর তিনি আমাদের ঘরে থাকতেন, তখন তার নিচে যে বিছানা থাকত, সামান্য পানি ছিটিয়ে ঝেড়ে দেয়ার জন্য আমাদের নির্দেশ দিতেন। তারপর উনি নামাজের জন্য দাঁড়াতেন এবং আমরাও তার পেছনে দাঁড়াতাম। আর তিনি আমাদের নিয়ে নামাজ আদায় করতেন। (বোখারি , হাদিস : ৫৭৭০, আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৮৫)।
আদব শিক্ষা দেওয়া : রাসুল (সা.) কোমল ও মমতাপূর্ণভাবে শিশুদের সঠিক আচরণ শিখিয়েছেন। ছোটখাটো ভুলত্রুটি ক্ষমা করে সঠিক বিষয় বুঝিয়ে দিতেন, যা তাদের সুন্দর জীবন গঠনে সহায়ক হতো। উমর ইবনে আবু সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ছোট ছেলে হিসাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তত্ত্বাবধানে ছিলাম। খাবার বাসনে আমার হাত ছুটাছুটি করত। রাসুল (সা.) আমাকে বললেন, হে বৎস! বিসমিল্লাহ বলে ডান হাতে আহার কর এবং তোমার কাছের থেকে খাও। এরপর থেকে আমি সবসময় এ পদ্ধতিতেই আহার করতাম। যার যার কাছ থেকে আহার করা। (বোখারি, হাদিস : ৪৯৮৪)।
শিশুদের কষ্ট না দেওয়া : রাসুলুল্লাহ (সা.) সাধারণত নামাজের প্রতিটি অংশে পরিমিত সময় বরাদ্দ রাখতেন। কিন্তু কখনো কখনো বিশেষ পরিস্থিতিতে নামাজ দীর্ঘ করতেন। একদিন ইশার নামাজে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নাতি পিঠের উপর ওঠার কারণে তিনি সিজদা দীর্ঘ করেছেন। তাড়াহুড়ো করে উঠতে অপছন্দ করেছেন যেন বাচ্চার কষ্ট না হয়।
শাদ্দাদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ইশার নামাজে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের দিকে বেরিয়ে আসলেন। তখন তিনি হাসান অথবা হুসাইন (রা.)-কে বহন করে আনছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) সামনে অগ্রসর হয়ে তাকে রেখে দিলেন। তারপর নামাজের জন্য তাকবীর বললেন ও নামাজ আদায় করলেন। নামাজের মধ্যে একটি সিজদা লম্বা করলেন।
(হাদিসের অন্যতম রাবী আব্দুল্লাহ বলেন), আমার পিতা (শাদ্দাদ) বলেন, আমি আমার মাথা উঠালাম এবং দেখলাম, ওই ছেলেটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পিঠের উপর রয়েছেন। আর তিনি সিজদারত। তারপর আমি আমার সিজদায় গেলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজ শেষ করলে লোকেরা বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আপনার নামাজের মধ্যে একটি সিজদা এত লম্বা করলেন, যাতে আমরা ধারণা করলাম, হয়তো কোনো ব্যাপার ঘটে থাকবে।
অথবা আপনার উপর ওহি নাজিল হচ্ছে। তিনি বললেন, এর কোনোটাই ঘটেনি। বরং আমার এ সন্তান আমাকে সওয়ারী বানিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি উঠতে অপছন্দ করলাম, যেন সে তার কাজ সমাধা করতে পারে। (নাসায়ী, হাদিস : ১১৪১)।
উত্তম ব্যবহার করা : শিশুদের কথা, কাজ ও চলাফেরা সবকিছুতেই ভুল হওয়া স্বাভাবিক। তাদের ভুল-ভ্রান্তির জন্য কড়া ধমক দেওয়া বা অতিরিক্ত শাসন করা ঠিক নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেকটি শিশুর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করতেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন, আমি ১০ বছর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খিদমত করেছি। আল্লাহর কসম! তিনি কখনো আমাকে উহ শব্দও বলেননি এবং কোন সময় আমাকে এটা কেন করলে, ওটা কেন করনি তাও বলেননি। (মুসলিম, হাদিস : ৫৮০৫)। রাসুল (সা.)-এর অনুসরণে প্রতিটি মুমিনের জীবনে দয়া, মমতা ও ভালোবাসা থাকা আবশ্যক। এটি সুন্দর পরিবার এবং সুষ্ঠু সমাজ গঠনের অন্যতম হাতিয়ার।