মঙ্গলবার ১৮ মার্চ ২০২৫। ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস ১৪৪৬ হিজরি ইসলামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ই রমজান এ ঐতিহাসিক জিহাদে মুসলমানদের বিজয় রচিত হয়। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বদরের যুদ্ধকে ইয়াওমুল ফুরকান বা ফয়সালাকারী দিন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বদরযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পবিত্র মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম তথা মুসলমানদের বিজয়ের ধারা সূচিত হয়েছিল এবং পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বদর যুদ্ধের বিজয় ছিল বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষের বিজয়। বদর ইসলাম ও মুসলমানের জয়ের ইতিহাস। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে হিজরি দ্বিতীয় সনের সতেরোই রমজান মদিনা থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয়েছিল বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের লড়াই ‘বদরযুদ্ধ’। বদর হলো অধিক সংখ্যকের ওপর স্বল্পসংখ্যক মুমিনের সফলকাম হওয়ার ইতিহাস। বদর হলো যুদ্ধের ময়দানে ফেরেশতা দিয়ে মুমিনদের আল্লাহর সাহায্য করার ইতিহাস। এ যুদ্ধ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘সেই দুই দলের মধ্যে তোমাদের জন্য অনেক নিদর্শন ছিল, যারা (বদরে) পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। একটি দল আল্লাহর পথে লড়াই করছিল, আর অপর দলটি ছিল কাফের। চক্ষুষ্মান লোকেরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল যে, কাফেরদের দল মুমিনের দল অপেক্ষা দ্বিগুণ, কিন্তু (ফল প্রমাণ করল যে) আল্লাহ যাকে চান তাকেই তার সাহায্যে ও বিজয় দান করেন। বস্তুত দৃষ্টিমান লোকদের জন্য এতে খুবই উপদেশ ও শিক্ষার বস্তু নিহিত রয়েছে।’ (সূরা আল ইমরান: ১৩)
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর সেখানে বিভিন্ন জাতি-ধর্মের লোকদের সমন্বয়ে মদিনা সনদের ভিত্তিতে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন এর অধিপতি। মদিনায় রাসুল (সা.) তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে অতি অল্প সময়ের মধ্যে শতধা বিভক্ত জাতিকে একটি সুশৃঙ্খল জাতিতে (উম্মাহ) পরিণত করেন। একটি নতুন ধর্ম ও রাষ্ট্রের উত্থান এবং মহানবী (সা.) ও মুসলমানদের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি মক্কা-মদিনার ইসলামবিরোধী শক্তিগুলোর জন্য প্রবল আতঙ্ক ও গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া একটি নতুন ধর্মের উন্মেষে নিজেদের প্রাধান্য খর্ব হয়। স্বতন্ত্র একটি মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে মক্কা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত কুরাইশদের যে অবাধ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল তাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এবং নাখলার খণ্ডযুদ্ধ প্রভৃতি কারণ মক্কার কুরাইশদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করে। হিজরি দ্বিতীয় বর্ষের ১৭ রমজান ৩১৩ জন সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে মহানবী (সা.) মদিনা শরিফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ৮০ মাইল দূরে বদর নামক স্থানে কাফেরদের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ইতিহাসে এ যুদ্ধকে বদর যুদ্ধ বলে অবহিত করা হয়। ঐতিহাসিক এ যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সৈন্য সংখ্যা ছিল ছিল মাত্র ৩১৩ জন। এর মধ্যে ৭০ জন মুহাজির ও বাকিরা আনসার। অন্যদিকে কাফের কুরাইশ বাহিনীর সংখ্যা ছিল এক হাজার। তন্মধ্যে ১০০ জন অশ্বারোহী, ৭০০ জন উষ্টারোহী ও বাকিরা পদব্রজী ছিল। সত্যপথের অনুসারী অল্পসংখ্যক রোজাদার মুসলমান বিশাল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মিথ্যার অনুসারী কাফের মুশরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করায় সত্য-মিথ্যার চিরপার্থক্য সূচিত হয়ে যায়। তাই বদর দিবসকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের দিন বলা হয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তার সৈন্যদের নিয়ে বদর অভিমুখে রওনা হন। আবু সুফিয়ান মুসলিমদের অবস্থা জানতে পেরে কুরাইশদের কাছে এ মর্মে একজন সংবাদবাহক পাঠায়, যেন কুরাইশরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। তাই আবু সুফিয়ান রাস্তা পরিবর্তন করে সমুদ্র উপকূল ধরে রওনা দিল এবং নিরাপদে পৌঁছে যান। কিন্তু কুরাইশ সম্প্রপ্রদায় তাদের কাছে সংবাদবাহকের মাধ্যমে সংবাদ পৌঁছামাত্রই তাদের নেতৃস্থানীয় ১ হাজার লোক সদলবলে যুদ্ধের উদ্দেশে রওনা দেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর সৈন্যদল সাহাবীদের সঙ্গে নিয়ে চললেন এবং বদর কূপগুলোর কাছের পানির কূপের সম্মুখে যাত্রাবিরতি দিলেন। মুসলিমরা যুদ্ধের মাঠে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জন্য উঁচু স্থানে একটি তাঁবু বানালেন, যেখান থেকে যুদ্ধের ময়দান দেখা যায়। তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) সেখান থেকে নামলেন, সাহাবিদের কাতার সুন্দর করে সাজালেন, যুদ্ধের ময়দানে চলতে থাকলেন এবং মুশরিকদের পতনের স্থল ও হত্যার স্থানগুলোর দিকে ইঙ্গিত করতে থাকলেন। আর তিনি বলছিলেন, ‘আল্লাহ চাহে তো এটা অমুকের পতিত হওয়ার জায়গা, এটা অমুকের মৃত্যুস্থান।’ পরে দেখা গেল রাসুলের ইঙ্গিতের জায়গা থেকে ওই লোকদের মৃত্যু সামান্যও হেরফের হয়নি। (মুসলিমণ্ড১৭৭৯) অতঃপর দুইটি দল (মুসলিম ও মুশরিক) পরস্পর মুখোমুখি হলো। যুদ্ধ চলতে থাকল রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁবুতে অবস্থান করলেন। তার সঙ্গে ছিলেন আবু বকর (রা.) ও সা’দ ইবন মু’আয (রা.)। তারা দুইজনই রাসুলুল্লাহ (সা.)কে পাহারা দিচ্ছিলেন। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় রবের কাছে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কাতর প্রার্থনা জানালেন; সাহায্য ও বিজয়ের প্রার্থনা করলেন; যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে রাসুল (সা.) আল্লাহর দরবারে বার বার দোয়া করছিলেন: হে আল্লাহ্! তুমি আমার সঙ্গে যে ওয়াদা করেছ তা পূর্ণ করো, হে রাব্বুল আলামিন আজ যদি এই মুষ্টিমেয় লোকের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত তোমার ইবাদত করার কেউ থাকবে না।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে: স্মরণ করো, তোমরা তোমাদের রবের নিকট সাহায্যের জন্য দোয়া করেছিলে। তিনি তা কবুল করেন এবং বলেন: আমি তোমাদের সাহায্য করব সহস্র ফেরেশতা দ্বারা যারা একের পর এক আসবে। (সুরা আন্ ফাল-৯) অতঃপর রাসুল (সা.) সামান্যতম সময়ের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। তারপর এ অবস্থা থেকে বের হয়ে বললেন, ‘অবশ্যই কাফিররা পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠদেশ দেখিয়ে পলায়ন করবে।’ (সুরা কামার- ৪৫) আর যুদ্বের এক পর্যায়ে মুসলমানরা ‘ইয়া মানসুর আমিত’ স্লোগান দিয়ে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধে মক্কার কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুয়াজ ইবনে আমর ও মুয়াজ ইবনে আফরা কুরাইশ পক্ষের সর্বাধিনায়ক আবু জাহলকে হত্যা করেন। বিলালের হাতে তার সাবেক মনিব উমাইয়া ইবনে খালাফ নিহত হয়। উমর ইবনুল খাত্তাব তার মামা আস ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে হত্যা করেন। বিকালের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। কুরআনে উল্লেখ রয়েছে যে, এই যুদ্ধে হাজারো ফেরেশতা মুসলিমদের সহায়তার জন্য এসেছিল। অসামান্য রণনৈপুণ্য, অপূর্ব বীরবিক্রম ও অপরিসীম নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে যুদ্ধ করে মুসলমানরা গুরুত্বপূর্ণ বদর যুদ্ধে বিধর্মী কুরাইশদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। এ যুদ্ধে কুরাইশদের ৭০ জন নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্দি হয়। ১৪ জন সাহাবি শহিদ হন। তাদের ১৩ জনের কবর এবং নামফলক বদর প্রান্তরে সংরক্ষিত রয়েছে। আর একজন সাহাবি আহত অবস্থায় মদিনায় ফেরার পথে কিছুদূর আসার পর শাহাদত বরণ করেন। সেখানেই তার সমাধি হয়। এ যুদ্ধে মুসলমানদের কেউ বন্দি হননি। পরিশেষে, ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে মুসলিমদের জন্য ছিল অভাবনীয় বিজয়। আর মহান আল্লাহর একান্ত কুদরতের প্রমাণ। তিনি অল্প সংখ্যক লোক দিয়েও বিজয় দান করেন। তাতে সূচনা হয়েছিল ইসলাম বিজয়। তাই প্রতি বছর ১৭ রমজান বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ঐতিহাসিক বদর দিবস।
বদর দিবসে মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে দান করুন ইসলাম ও মুসলমানদের বিজয়। সব নেয়ামত মাগফেরাত ও নাজাতে ভরে ওঠুক রোজাদারের আমল ও মন। আর মহান আল্লাহর কাছে বেশি বেশি প্রার্থনা করার তাওফিক দান করুন। বদর যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী সাহাবাদের দান করুন জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মান। আমিন।
লেখক, কলাম লেখক ও গবেষক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি