ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫, ১৩ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঈদ শুধু আনন্দ নয়, ইবাদতও

ঈদ শুধু আনন্দ নয়, ইবাদতও

ঈদ মুসলমানদের একটি ধর্মীয় উৎসব। ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। এ আনন্দ ও খুশির সঙ্গত কারণ আছে। আনন্দ প্রকাশের নিয়ম, ধরন ও মাত্রা আছে। যে কোনো ধরনের আনন্দই ঈদের আনন্দ নয়। আবার হালাল হারাম, বৈধ-অবৈধ বাছবিচার ছাড়া আনন্দ প্রকাশের যেকোনো উপকরণ ও বিনোদন গ্রহণের অনুমোদন নেই ইসলামি শরিয়তে। কারণ ঈদ নিছক আনন্দের উৎসব নয়। ঈদ ইবাদতেরও বড় একটি অংশ। ভুলে গেলে চলবে না এটি মুসলিম উম্মাহর বিশেষ ধর্মীয় উৎসব। ঈদ মুসলমানদের সংস্কৃতি। তাই ইসলামি শরিয়ত ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকেই ঈদ উদযাপন করতে হবে। নিজেদের মনগড়া ধ্যান-ধারণার আলোকে কিংবা ইসলাম অসমর্থিত কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করে ঈদ উদ্যাপন করার মাঝে কোনো সার্থকতা নেই।

ঈদুল ফিতরের মূল আবেদন : মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতরের আগমন ঘটে। ঈদুল ফিতরের এ বিশেষ দিনটি আল্লাহ বান্দাকে দিয়েছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের জন্য। মহান রব দয়া করে বান্দাকে রমজানের সবকটি রোজা রাখার এবং তার ইবাদতে পুরো একটি মাস কাটানোর তৌফিক দিয়েছেন, এটা আল্লাহর বড় কৃপা বান্দার উপর। আর বান্দা ইবাদতের সুযোগ পেয়ে ধন্য। তাই মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করা ঈদুল ফিতরের মূল আবেদন ও তাৎপর্য। রমজান মাসে রোজা রাখতে পেরে এবং আল্লাহর ইবাদত করার বিশেষ ও অবারিত সুযোগ পেয়ে মোমিন হৃদয়ে আনন্দের যে দোল খাওয়া সমীরণ বয়ে যায়, ঈদুল ফিতর হলো সেই আনন্দ প্রকাশ করার উৎসব।

কেমন হবে ঈদের আনন্দ : ঈদুল ফিতরের আনন্দের প্রকাশ শুরু হয়ে যায় শাওয়ালের চাঁদ দেখার পর থেকে। আর এর পূর্ণতা পায় দলে দলে ঈদগাহে হাজির হয়ে মহান রবের কৃতজ্ঞতায় সালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে। মহান রবের মহিমা ও বড়ত্বের ঘোষণা দিয়ে তাকবির পাঠ করা এবং সিয়ামসাধনা যেন আল্লাহর দরবারে কবুল হয় সেজন্য একে অপরের কাছে দোয়া চাওয়া ঈদুল ফিতরের অন্যতম কাজ। এটা তাৎপর্যপূর্ণ আনন্দেরও বহিঃপ্রকাশ। ঈদের দিন মুসল্লিগণ ঈদগাহে যায়। নতুন টুপি, নতুন পাঞ্জাবি পরে। ঈদগাহে ইমামের বয়ান শোনে। নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে কোলাকুলি করে। এ সবই ইবাদত মিশেল আনন্দ প্রকাশ। ঈদের দিন একটি দোয়া পড়ে এক মুসলিম অপর মুসলিমের সঙ্গে কুশল বিনিময় করবে। যা সাহাবায়ে কেরাম পড়তেন। ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ অর্থাৎ আল্লাহ কবুল করুন- রমজান মাসে ও আজকের দিনে করা আমাদের ও তোমাদের সমস্ত নেক আমল।

পূববর্তী নেককার মুসলিমদের ঈদ : পূর্ববর্তী নেককার মুসলিমগণ ছিলেন পাক্কা ঈমানদার। তারা গোনাহ বর্জন করে চলতেন। নেক আমলে খুব গুরুত্ব প্রদান করতেন। এ জাতীয় নেককার বান্দাদের সালাফে সালেহীন বলা হয়। তারা ঈদকে ইসলামের অন্যতম সম্মানিত দিন হিসেবে পালন করতেন। বিভিন্ন হারামে জড়িয়ে এ দিনের পবিত্রতা লঙ্ঘন করতেন না। কোনো কর্তব্য কাজে শিথিলতা করেননি। তারা এ দিনটিতে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন জায়েয খাবার ও পানীয় এবং পরিমিত ও পরিমার্জিত সাজসজ্জার মধ্যে। আর সেসব কাজ তারা করতেন যা মুমিন-হৃদয়ে প্রফুল্লতা আনে, যেমন- আল্লাহর যিকির, তাসবিহ-তাকবির, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা এবং নির্দোষ হাসি-আনন্দ ও বৈধ বিনোদন। নিজের ও পরিবারের জন্য ভালো মানের খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা ইত্যাদি।

বিশিষ্ট জ্ঞানতাপস ও বুজুর্গ ব্যক্তি ওয়াকি’ (রহ.) বর্ণনা করেন, আমরা ঈদের দিন সুফিয়ান সাওরীর সাথে বের হয়েছিলাম; তখন তিনি বললেন, এই দিনটি আমরা প্রথম যে কাজ দিয়ে শুরু করি, তা হলো দৃষ্টি অবনত করা। (আলওয়ারা‘, ইবনু আবিদ দুনইয়া : পৃ. ৯৬৩)। আলী (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তিনি রমজানের শেষ রাত্রিতে বলতে থাকতেন- ‘ইয়া লাইতা শা’রী! মান হাজাল মাকবূলু ফানুহান্নিহি? ওয়া মান হাজাল মাহরূমু ফানুআজ্জিহি? (অর্থ) হায়, জানা নেই, কে আমাদের মাঝে মাকবুল, যাকে স্বাগত জানাব! আর কে আমাদের মাঝে মাহরূম, যাকে সমবেদনা জানাব! (লাতাইফুল মাআরিফ, ইবনে রজব হাম্বলী, পৃ. ৩৬৯)। সালাফে সালেহীন ঈদের দিন এই চিন্তাতেই বিভোর থাকতেন। তার ভেতর দিয়েই হত তাদের ঈদ উদযাপন।

আনন্দ-বিনোদনের নামে হারাম ও গর্হিত কাজে লিপ্ত হওয়া তো কল্পনাতীত। কারণ, বিবেকবান পরহেযগার মানুষের কাছে পাপাচারের পঙ্কিলতায় ডুবে যাওয়া কোনোভাবেই আনন্দের বিষয় হতে পারে না, আনন্দ উদ্যাপনের তরিকা হতে পারে না। হাসান বসরী (রহ.) বলতেন, ‘কুল্লু ইয়াওমিন লা তা’ছিল্লাহা ফীহি ফাহুয়া লাকা ঈদুন’ অর্থাৎ, আল্লাহর নাফরমানি কর না এমন প্রতিটি দিন, তোমার জন্য ঈদ। (লাতাইফুল মাআরিফ, ইবনে রজব হাম্বলী: পৃ. ৫১২)।

ঈদের দিনের সুন্নাত আমল : ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। মিসওয়াক করা। ভালোভাবে গোসল করা। আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করা। সাধ্যানুযায়ী সুন্দর, পবিত্র ও উত্তম পোশাক পরিধান করা। সাদকাতুল ফিতর ঈদের নামাজের আগেই আদায় করা। ঈদুল ফিতর নামাজের আগে কিছু খাওয়া এবং ঈদুল আজহায় কোরবানির পর খাওয়া। পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। ঈদগাহে এক রাস্তায় যাওয়া এবং অন্য রাস্তায় ফিরা। ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার সময় আস্তে আস্তে এই তাকবির পড়া- ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ (আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনাদের কবুল করুন)। এ বাক্য বলে অপর মুসলমানকে অভ্যর্থনা জানানো।

লেখক : ভাইস প্রিন্সিপাল, ঢাকা আইডিয়াল সিটিজেন মাদ্রাসা, মানিকনগর, মুগদা, ঢাকা

ঈদ,আনন্দ,ইবাদত
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত