রমজান বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে রমজানের বরকতময় দিনগুলো, শেষ দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ রাতগুলো। যা অত্যন্ত জ্যোতির্ময়। যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত অমূল্য, প্রতিটি সিজদা উচ্চ মর্যাদার সোপান। আর প্রতিটি ঘণ্টা রহমতে ভরা ও বরকতে স্নাত। এ সময়ে আল্লাহর দয়া বিশেষভাবে প্রকাশ পায়। মুক্তির দরজাগুলো খুলে যায় ও ক্ষমা বর্ষিত হয়। এই রাতগুলোতে বিশ্বনবী (সা.) অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি ইবাদত করতেন। তিনি রাত জাগতেন, বেশি বেশি তাহাজ্জুদ পড়তেন। এমনভাবে দোয়া করতেন যেন এটিই শেষ সুযোগ। কারণ তিনি জানতেন, এই রাতগুলোর মাঝে রয়েছে লাইলাতুল কদর; যে রাতে আল্লাহ কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। এই রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। কী অপার দান! কী দয়া ও রহমতের প্রবাহ! এক রাতের ইবাদত সমস্ত পাপ মুছে দিতে পারে, গোনাহ ক্ষমা করে দিতে পারে, আত্মাকে উন্নীত করে পরিশুদ্ধ করে তুলতে পারে।
নৈকট্য লাভের রাত : রমজানের শেষ দশকের রাতগুলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের রাত, যখন সাহরির মুহূর্তে বিনয়ের অশ্রু ঝরে, গভীর রাতে তওবার মৃদু ধ্বনি শোনা যায় ও দয়াময় আল্লাহর সামনে মানুষ বিনম্র হয়ে দাঁড়ায়। যে এই রাতগুলোকে অবহেলা করল, সে রমজানের শ্রেষ্ঠ সময় হারাল। যে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারল না, সে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হলো। যারা এখনো ঘাটতি রেখেছে, তাদের জন্য এই শেষ দশ রাত রয়েছে, এখনো সময় আছে ফিরে আসার, এখনো সুযোগ আছে অমূল্য মুহূর্তগুলো কাজে লাগানোর, যাতে শেষ পর্যন্ত আফসোস করতে না হয়, ‘হায়! আমার এ জীবনের জন্যে আমি যদি কিছু অগ্রিম পাঠাতাম!’ (সুরা ফজর : ২৪)।
এই রাতগুলোতে বান্দা আল্লাহর কাছে কাঁদো কাঁদো স্বরে নিজেকে উপস্থাপন করে। তওবা করে অশ্রু ঝরায়। বিনীত হৃদয়ে কোরআন তেলাওয়াত করে। ফলে গোনাহ মোচন হয় এবং আত্মা প্রশান্তি ও নৈকট্য লাভ করে। কত পথভ্রষ্ট এই রাতগুলোর বরকতে সঠিক পথ পেয়েছে! কত গাফিল জাগ্রত হয়েছে! কত পাপী তওবার অশ্রুতে পরিশুদ্ধ হয়েছে! তাই ধন্য সেই ব্যক্তি, যে এই রাতগুলোকে তার জীবনের মোড় ঘোরানোর সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে! আর কত দুর্ভাগ্য সেই ব্যক্তির, যে এগুলোকে অবহেলায় নষ্ট করে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, যখন রমজানের শেষ দশক আসত, তখন মহানবী (সা.) তার কোমর বেঁধে নিতেন। নিজে রাত জাগতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। (বোখারি : ২০২৪)। ‘কোমর বেঁধে নেওয়া’ বলতে বোঝানো হয়, তিনি ইবাদতে কঠোর পরিশ্রম করতেন ও দুনিয়ার ব্যাপারে মনোযোগ কমিয়ে দিতেন। তিনি এসব রাতে কখনো বিশ্রামের সুযোগ দিতেন না, আল্লাহর সামনে বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সিজদায় লুটিয়ে পড়তেন। কাকুতি-মিনতি করে দোয়া করতেন। শুধু নিজেই করতেন না, বরং পরিবারের সদস্যদেরও উৎসাহিত করতেন এই মূল্যবান সময় কাজে লাগানোর জন্য। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘এ বিষয়ে প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করুক।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ২৬)।
গোনাহ মাফের সুযোগ : যখন রাত তার আঁধারের পর্দা টেনে দেয়, আর চোখগুলো ঘুমিয়ে পড়ে, তখন রহমত ও ক্ষমার আশায় তৃষ্ণার্ত আত্মাগুলো জেগে ওঠে। তারা বিনম্র চোখে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদে, বরকতময় কোরআন তেলাওয়াতের সুর বাতাসে ভেসে বেড়ায়, আর সেই শব্দগুলো আকাশের দিকে উঠে যায়। দয়া ও আশার পরশে ঘেরা থাকে। হে গোনাহের বোঝায় ভারাক্রান্ত মানুষ, হে পাপের ক্লান্ত পথিক! এটাই ক্ষমার সময়, এটাই প্রতিযোগিতার ময়দান! এখনই উঠে দাঁড়াও, তওবা কর ও সুযোগ গ্রহণ কর। কারণ এই দশ রাত চলে গেলে আর ফিরে আসবে না। দোয়ার দরজা উন্মুক্ত, আল্লাহর দান সীমাহীন, জিকিরে আত্মা প্রশান্ত হয়, হৃদয় শান্তি পায়, দান-সদকা দ্বিগুণ বরকত নিয়ে আসে, আর এতেকাফ হলো আত্মাকে শুদ্ধ করা ও ঈমানের সঙ্গে নতুন অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ। হে কল্যাণপ্রত্যাশী! এটাই তোমার সময়! হে আল্লাহর নৈকট্য চাওয়ার আকাঙ্ক্ষী, এটাই তোমার মুহূর্ত!
আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘অতএব তোমরা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা কর।’ (সুরা বাকারা : ১৪৮)। সংক্ষিপ্ত এই আয়াতে রয়েছে অসীম অর্থের গভীরতা। এটি কল্যাণ ও নিরাপত্তার বার্তা বয়ে আনে প্রতিটি ইবাদতকারী, প্রার্থনাকারী ও আল্লাহর সামনে বিনম্র হয়ে দাঁড়ানো মানুষের জন্য। এই রাতে শান্তি হলো অন্তরের প্রশান্তি, আত্মার মুক্তি, পাপ থেকে নিরাপত্তা, এমন এক রহমত যা কখনো কষ্টে পরিণত হয় না। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ শান্তি ও ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে বরকতময় অভ্যর্থনা, যা সমগ্র পৃথিবী ও এর অধিবাসীদের জন্য বর্ষিত হয়।
শান্তি বর্ষণের সীমা : লাইলাতুল কদরের রাতে ঈমানদারদের হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে যায়। কোনো ভয় থাকে না, কোনো দুশ্চিন্তা থাকে না, কোনো একাকিত্ব বা সংকীর্ণতা থাকে না। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘এই রাতে আল্লাহ শুধু শান্তি, প্রশান্তি ও নিরাপত্তাই নির্ধারণ করেন।’ যার জন্য এই রাতে কল্যাণ নির্ধারিত হয়, সে চিরকাল সৌভাগ্যবান হয়ে থাকে, আর যে তা থেকে বঞ্চিত হয়, সে অনন্তকাল অনুশোচনায় নিমজ্জিত থাকে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এসেছে, ‘শান্তিই শান্তি, সেই রজনী ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত।’ (সুরা কদর : ৫)।
এই শান্তি মধ্যরাতে শেষ হয় না, সাহরির আগেও বিলীন হয় না, বরং ফজরের আলো ফুটে ওঠা পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। আল্লাহ তার বান্দাদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দয়া ও অনুগ্রহ লাভের সুযোগ দেন, তাদের ডাকার জন্য অপেক্ষা করেন, ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান ও তাদের গোনাহ থেকে পবিত্র হওয়ার পথ উন্মুক্ত রাখেন। এটি এমন এক রাত, যার দান শেষ হয় না, যার রহমত কখনো নিঃশেষ হয় না। এটা শুধু তাদের জন্য, যারা একান্ত হৃদয়ে ফিরে আসে ও বিনম্র আত্মায় আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল তার প্রতি, যে তওবা করে, ঈমান আনে, সৎকর্ম করে ও সৎপথে অবিচলিত থাকে।’ (সুরা তহা : ৮২)।
এই রাত আমার ভাগ্য পরিবর্তনের কারণ হতে পারে! এটি হতে পারে গোনাহভারে চাপা-পড়া অতীত আর উজ্জ্বল তওবার ভবিষ্যতের মাঝখানের সীমারেখা। এটি আমার মর্যাদা বৃদ্ধি করতে পারে, আমার পাপ মোচন করতে পারে, আমার অবস্থা গাফলত থেকে হিদায়াতে পরিবর্তন করতে পারে। দূরত্ব থেকে নৈকট্যে নিয়ে আসতে পারে। বুদ্ধিমান মানুষ কখনো এই রাতকে অবহেলা করে না, কখনো মূল্যবান সময় বৃথা নষ্ট করে না, বরং সে বিনীতচিত্তে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদে, দোয়া করে ও দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালোবাসো, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও।’
ভাগ্যরজনী : লাইলাতুল কদরের এই বরকতময় রাতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয় এবং আল্লাহ তার অসীম প্রজ্ঞায় সৃষ্টির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এই রজনীতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।’ (সুরা দুখান : ৪)। এই রাতে রিজিক ও আয়ু নির্ধারিত হয় এবং পরবর্তী বছরের ভাগ্যলিপি লেখা হয়। অতএব, যে চায় তার দোয়া কবুল হোক, সে যেন বিনীত অন্তরে আল্লাহর দিকে ফিরে যায়। আল্লাহ তো পরম দয়ালু, তিনি কখনো সেই ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দেন না, যে একান্ত মনে তার দিকে ফিরে আসে।
(২১-০৯-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ২১-০৩-২০২৫ ঈসায়ি তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ )।