প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতনের দেশ বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে প্রত্যেক ঋতু তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবিভর্‚ত হয়। পৌষ ও মাঘ মিলে শীতকাল। তবে অগ্রহায়ণ মাস থেকেই শীতের সূচনা হতে থাকে। শীতের আগমনে পত্রকুঞ্জে এবং জলে-স্থলে সর্বত্রই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এ শীতকালের প্রকৃতি ও মানুষের পরিবর্তনের ধারা সবাইকে মুগ্ধ করে। কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতমনা মানুষের কাছে শীত আসে আশির্বাদ হয়ে। কারণ, এ দেশের শীতকালীন আবহাওয়া অনন্য এক রূপ নিয়ে আসে। গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলের মানুষ শীতের সময়ে আলাদা প্রশান্তির আমেজে খুঁজে পায়।
সাধারণত শীতের রাত দীর্ঘ হয়। এ সময়ে তীব্র ঠান্ডায় নিঃস্তব্ধ হয়ে যায় প্রকৃতি। এরই মাঝে মানুষ ঘরে ফিরে সারা রাতেই কম্বল, লেপ ও কাঁথা মুড়ি দিয়ে জড়সড় হয়ে গভীর তন্দ্রায় নিমজ্জিত হয়। যদিও দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য শীতকাল বড় কষ্টের বার্তা নিয়ে আসে। অসহায় ও হতদরিদ্রের কষ্ট বাড়তে থাকে। তারপরও শীতল রাত শেষে ভোর হয় অন্যরকম এক রূপে। ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে প্রকৃতি থাকে ঢাকা। তাই তো পরিবেশগত কারণে বছরের অন্য সময়ের তুলনায় শীতকেই ইতিবাচকভাবে দেখে মানুষ।
শীতকালীন বাহারি আমেজ : শীতকালে এ দেশের বেশ কিছু গাছে ফুল ফোটে। যেমনÑ গাঁদা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, গোলাপ ইত্যাদি। ফুলের দোকানগুলোতেও বাহারি ফুলে ভরে যায়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি বরণ করতে নানা ফুলের দোকানগুলোতে নানা রকম ফুলের ডালি, তোড়া কিংবা মালাসহ সুসজ্জিত ফুলের উপকরণ বিক্রি এবং কেনার হিড়িক পড়ে যায়। শীতকালের বহু শাকসবজিতে ক্ষেতখামার ভরে যায়। এ ছাড়া খেজুর গাছের মিষ্টি রস, নানান পিঠাসহ হরেক রকমের সুস্বাদু খাবার এ ঋতুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া ধানক্ষেত বা শাকসবজির ওপরে টলমল করা শিশির বিন্দু, সূর্যের সোনালি রশ্মিতে একপ্রকার মুক্তার মতোই মনে হয়। জামাই আদর করতে শীতের ঋতুকে বেছে নেন অনেকেই। এ সময় সুস্বাদু রসের পিঠা তৈরি করা হয় বাড়িতে বাড়িতে। আত্মীয়-স্বজনদের খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। শীতকালীন এ চিত্রগুলো বাংলার ঐতিহ্য। এ সময়কে ঘিরে হয় নবান্নের উৎসব। শীতে বেশির ভাগ জমিতেই ফসল থাকত না। তাই খোলা ফসলের জমিতে খেলাধুলার আয়োজন শুরু হয়। শহরেও মাঠে, সড়কে অথবা বাড়ির ছাদে বড় বড় বাতি জ্বালিয়ে খেলা হয় ব্যাডমিন্টন। শহরে মেলা বসে, গ্রামে বা গঞ্জে শীতে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। দেশি-বিদেশি অসংখ্য পাখি মুখরিত করে রাখে জলাশয়। এ সময় সূদূর সাইব্রেরিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে পাখিরা বাংলাদেশে এসে মাঠে-ঘাটে ও গাছে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়।
শীত কাটুক মানবতায় : তীব্র শীতের ভিন্নতার কারণে গ্রাম ও শহরে এর প্রভাবে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। শীত কারোর জন্য হয় আশীর্বাদ, আর কারোর জন্য হয় কষ্টের। শহরে যারা কংক্রিটের দালানে বসবাস করেন, তাদের কাছে শীত আশীর্বাদ। কিন্তু দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য শীতকাল বড় কষ্টের বার্তা নিয়ে আসে। অসহায় ও হতদরিদ্রের কষ্ট দিন দিন বাড়তেই থাকে। যারা খোলা আকাশের নিচে, ফুটপাত, বাস ও রেলস্টেশনে কিংবা নদীর পাড় ও রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা বস্তিতে বসবাস করেন, তাদের কষ্টের সীমা থাকে না। অতি সহজেই ঠান্ডা, জ্বর, সর্দি, কাশির মতো শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয় তারা। তারপরও বলতে হয়, আর্থসামাজিক উন্নয়নে শীত ঋতুর গুরুত্ব আমাদের দেশে অপরিসীম। সরিষা ফুলের হলুদ ক্ষেত আর মৌমাছির গুঞ্জনের দৃশ্য দেখলে পুলকিত হই। শীতের সকালে গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশা এত নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তারপর মাঝে মাঝে শুরু হয় শৈত্যপ্রবাহ। এ সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপমাত্রা খুব নিচে নেমে আসে। হাড় কাঁপানো তীব্র শীত গ্রাম বাংলার মানুষকে স্তব্ধ করে দেয়। সাধ্যমতো শীতবস্ত্র কেনার ধুম পড়ে যায়। শীতের সকালে ও রাতে ছিন্নমূল মানুষ আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চালায়।
গ্রাম বাংলার শীতকালীন সকাল : সকালে উঠে সূর্য ওঠার অপেক্ষায় উসখুস হয়ে থাকে শিশু কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ সবাই। চায়ের দোকানগুলোতে চা পানের ধুম পড়ে যায়। শীতকালে ঘুরে বেড়ানোর উত্তম সময়। তাছাড়া এ সময়টাতেই স্কুল-কলেজ একটা দীর্ঘ ছুটির কবলে পড়ে। তাই গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার ধুম পড়ে যায়। একই সঙ্গে দেশের দর্শনীয় স্থান এবং পিকনিক স্পটগুলোতে শীতকালেই ভ্রমণকারীদের ঢল নামে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষাসফর শুরু হয়। গ্রামের হাট-বাজারে বা উন্মুক্ত স্থানসহ সর্বত্র পিকনিকের আয়োজন বেড়ে যায়। শীতের সময়ে গ্রামের মাঠে মাঠে সোনালি ধান দোলা খায়। যা কাটাও শুরু হয় এ ঋতুতে। পাকা ধানের সোনালি ক্ষেতের দৃশ্য দেখে চোখ ফেরানো যায় না। বাতাসে নতুন ধানের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। কুয়াশাচ্ছন্ন তীব্র শীতের সকালে এ দেশের কৃষক লাঙল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে গরুসহ মাঠে যায়।