পৃথিবীর অদ্ভুতুড়ে প্রাণীগুলোর মধ্যে বাদুড় অন্যতম। বাদুড় পৃথিবীর একমাত্র উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানুষের সতর্কতাসহ বিভিন্ন কারণে এই প্রাণীটি আজ বিলুপ্তির পথে। ফল খেকো ও মশা খেকো বাদুড়ের প্রজাতিগুলোকে রক্ষা করা উচিত। এই বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার।
বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসন তৈরিসহ মানুষের বিভিন্ন চাহিদা মিটানোর প্রয়োজনে ব্যাপক পরিমাণে গাছ উজাড় করার কারণে আজ খুব অল্প সংখ্যক বিশালদেহী ফলখেকো বাদুড় টিকে আছে। ক্রমেই বাদুড় ও মানুষের নৈশযুদ্ধের কথা ইতিহাসের অংশে পরিণত হচ্ছে।
আগে আবাসিক এলাকায় বাদুড় সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান ছিল। একসময় বিকেল হলেই নিশাচর বাদুড়ে ভরে যেতো আকাশ। এরমধ্যে ডাইনি বাদুড়, ক্ষুদে চামচিকা ও বামণ চামচিকা ছিল বেশি। তারা সাধারণত পরিত্যক্ত ভবনের আঁধার কোণায় লুকিয়ে থাকত, রাতে মূলত খাবারের সন্ধানে বাহির হত এবং মানব রাজ্যের জন্য সমস্যা তৈরি করত না। বিশেষ করে গোধূলিতে এদের বেশি দেখা যেত। এদের বড় বড় দুটো কান ও ছাতার মতো দেখতে অদ্ভুত দুটো পাখনা আছে।
পৃথিবীতে প্রায় ১১০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। যা সব স্তন্যপায়ী প্রজাতির প্রায় এক চতুর্থাংশ। প্রায় ৭০ ভাগ বাদুড় পতঙ্গভুগী। বাকিরা ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণ করে। নিশাচর এই প্রাণী দিনের বেলায় অন্ধকার স্থানে উলটো হয়ে ঝুলে থাকে। তথ্যমতে, এই প্রাণীটির আবির্ভাব হয়েছিল প্রায় পাঁচ কোটি ২৫ লাখ বছর আগে।
এক জরিপের তথ্য মতে, পৃথিবীতে এক হাজার ২৪০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। এসব বাদুড়কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ বাদুড় কীটভুক্ত। কীট খেয়ে তারা বিশ্বের গাছপালা ও ফসলের উপকার করে বা ভারসাম্য রক্ষা করে। বাকি ৩০ শতাংশ বাদুড়ের মধ্যে বেশির ভাগ ফলাহারী। মাছখোর বাদুড়রা কীটপতঙ্গ নয় বরং জন্তু-জানোয়ারের ওপর নির্ভরশীল।
আগে গ্রাম গঞ্জের আনাচে-কানাচে ছোট-বড় বিভিন্ন জাতের ও নানান ধরনের বাদুড় দেখা যেত। এখন বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে বাদুড় একটি বিপন্ন প্রাণী। কীটনাশক ব্যবহারে বাদুড়ের প্রধান খাদ্য পোকামাকড় ধ্বংস হচ্ছে। কীটনাশকের প্রভাব শুধু বাদুড়ের উপর নয়, সকল প্রাণীর উপর পড়ছে। এটা ব্যবহারে ফল ও ফসল হয়ে উঠছে বিষাক্ত। জীববৈচিতত্র্য যদি এভাবে ধ্বংসের মুখে পড়ে, কোন একসময় মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী যে অস্তিত্বের সংকটে পড়বেনা, তা কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায় না। যদিও এই প্রাণী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল আন্তর্জাতিক বাদুড় দিবস পালিত হয়। ২০১১ সাল ছিল আন্তর্জাতিক বাদুড় বর্ষ।
বাদুড় রাতের আধারে চুপিসারে আমাদের ফল ও ফসলের কিছু ভাগ নিলেও, বুনো গাছপালার পরাগায়ন, বীজ-বিস্তরণ ও ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের দ্বিগুণ সহায়তা করে থাকে। এটি কলা, অ্যাভোকাডো আম, লিচু, পেয়ারা ও সফেদা ও আমের মতো বিভিন্ন ফলসহ অনেক উদ্ভিদের পরাগায়নের ক্ষেত্রে বাদুড় প্রধান ভূমিকা পালন করে। পাঁচশ’রও বেশি উদ্ভিদ পরাগায়নের ক্ষেত্রে বাদুড়ের উপর নির্ভরশীল। বাদুড় বিলুপ্ত হলে কলা, অ্যাভোকাডো ও আমের মতো ফল ও ফসলগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাদাম, ডুমুর ও চকোলেটের প্রধান উপাদান কোকোর মতো ফসলের বীজ ছড়াতে বাদুড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এরা বট, আম, ছাতিম, রেইনট্রি, গগণশিরীষ, নারিকেল, তাল, সুপারি, খেজুর গাছে ও বাঁশঝাড়ে দলবদ্ধ ভাবে ঝুলে থাকে। এরা চলার পথে প্রতি সেকেন্ডে উচ্চমাত্রার শব্দতরঙ্গ তৈরি করতে পারে। এই তরঙ্গ শিকারের গায়ে লেগে প্রতিধ্বনি হিসেবে বাদুড়ের কাছে ফিরে আসে। আর ওই প্রতিধ্বনিকে কাজে লাগিয়ে বাদুড় পোকামাকড়ের অবস্থান শনাক্ত করতে পারে এবং শিকার করে।
একটি প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ বাদুড় ঘণ্টায় ৬০ মাইল বা এর বেশি গতিতে উড়তে পারে। এটিই পৃথিবীর দ্রুততম স্তন্যপায়ী প্রাণী। বাদুড় সাধারণত ৩০ বছরের বেশি সময় বেঁচে থাকে। বাদুড়ের গর্ভধারণকাল ৩ থেকে ৫ মাস। শীতের শেষ বা গ্রীষ্মের শুরুতে বাচ্চা প্রসব করে। মা বাদুড় বছরে একবার বাচ্চা দিয়ে থাকে। বাচ্চাগুলো প্রাপ্ত বয়স্ক নাহওয়া পর্যন্ত প্রথম ২-৩ মাস মায়ের শরীরেই সেঁধে থাকে।
বাদুড় হলো মশা মারার প্রাকৃতিক মেশিন। প্রতিরাতে এই প্রাণীটি নিজের শরীরের ওজনের সমপরিমাণ পোকামাকড় খেয়ে সাবাড় করতে পারে। সুতরাং ক্ষতিকর পোকা দমনে বাদুড় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাদুড় সাধারণত ফল ও ফলের রস, পতঙ্গ, মাকড়সা, মাছ, ব্যাঙ, ছোট সরীসৃপ ও পাখি, ক্ষুদে বাদুড় ও অন্যান্য ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে। নিশাচর এই প্রাণীটি প্রতি ঘণ্টায় সহ¯সহস্রাধিক মশা এবং এ জাতীয় পোকামাকড় খেয়ে থাকে। তবে বর্তমানে বিভিন্ন কারণে বাদুড় অস্তিত্বের হুমকির সম্মুখীন। ফলশ্রুতিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গু মশার ভয়াবহ বিস্তার দেখে দিয়েছে। দিন দিন বাড়ছে মশা বাহিত বিভিন্ন রোগ বালাই।
এক গবেষণার জরিপে জানা গেছে, ১৫০টি প্রাপ্ত বয়স্ক বাদুড় বছরে ফসলের জন্য ক্ষতিকর যে পরিমাণ পোকা খেয়ে সাবাড় করে, তা পৃথিবীর কৃষকদের অন্তত এক বিলিয়ন ডলার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া ও ম্যালিরিয়ার মতো রোগের বিস্তার ঘটে মশা থেকে। মশা দমন করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই বাদুড় নামক স্তন্যপায়ী প্রাণীটিকে রক্ষা করতে হবে। তাছাড়া বিভিন্ন ফল ও ফসলের পরাগায়ন নিশ্চিত করতে বাদুড়ের জুড়ি নেই। তাই বাদুড়ের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে, আমাদের অস্তিত্বও হুমকিতে পড়বে বলে পরিবেশ ও প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন।